জারুল ফুল নজর কাড়ছে, মনও রাঙাচ্ছে

জারুল ফুলে ছেয়ে গেছে গাছ। বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপারের অন্তেহরি সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

কাউয়াদিঘি হাওরপারের গ্রাম অন্তেহরির দিকে রওনা দিতেই সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। গ্রামের পথে ঘরমুখী মানুষ ছুটছেন, কেউ মাঠ থেকে গবাদিপশু নিয়ে বাড়ির দিকে, আবার কেউ অন্য কোথাও থেকে। আবার নিত্যপণ্য কিনতে কেউ হাটের দিকে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে সড়কের মোড়ে, গাছতলায়, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন অনেকে। বোরো ধান তোলার মৌসুম হলেও এরই মধ্যে অনেকেরই ধান কাটা শেষ। যাঁর যাঁর মতো গোলায় ধান তুলে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন।

বর্ষা না এলেও বর্ষার অবসর এসে গেছে। ধান কেটে নিয়ে যাওয়ায় সড়কের দুই পাশে এখন অগ্রহায়ণের মতো শুকনো ধূসর নাড়া ভরা মাঠ পড়ে আছে। কোথাও শুকানো খড়ের স্তূপ করে রাখা। গরমের ভোগান্তি থাকলেও নিরাপদে ধান ঘরে তুলতে পারায় কৃষকের মনে আছে স্বস্তি। তবে হাওরের উঁচু স্থানে ও বিভিন্ন বাড়ির আশপাশে এখনো কিছু ধান রয়ে গেছে। এসব জমির মালিকদের ব্যস্ততা অবশ্য এখনো শেষ হয়নি।

মৌলভীবাজার শহর থেকে বেরিয়ে সড়ক ধরে অন্তেহরির দিকে যেতেই পথে পথে নজরকাড়া ফুলের দেখা মেলে। পথের দুই পাশে কাঁঠাল, বট, হিজল—সবই আছে। আর তার ফাঁকে বেগুনি রঙের যেন বান এসেছে। ফুটেছে জারুল ফুল। পথের পাশের প্রায় বাড়িতেই আছে এমন দু-চারটি জারুলগাছ। পথের পাশেও আছে। থোকায় থোকায়, গুচ্ছগুচ্ছ ফুল পাপড়ি মেলেছে। চোখ ধরে থাকে এই রঙে। হাওয়ায় ছোট ছোট পাপড়ি উড়ছে। অন্তেহরি যাওয়ার পথটিতে যে কটি গ্রাম পড়েছে, সব কটি গ্রামই এখন জারুলের রঙে সেজেছে। তাতে আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে গাছ। আর তাতে মায়াবী করে তুলেছে ফুলের বন্যায় তলিয়ে থাকা শাখা-প্রশাখা।

অন্তেহরি বাজার পেরিয়ে একটি কালভার্ট, সেই কালভার্টের কাছেই পশ্চিমে একটি গাছে হাতের নাগালেই ঝুলে থাকা জারুলের ফুলগুলো যেন চোখ খুলে ডাকছে কাউকে। হাওয়া এলে নাচছেও তারা। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘন অন্ধকারের কাছে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। কালভার্ট থেকে কিছুটা উত্তরে একটি বাড়ি আছে। সেটি খোকা বাবুর বাড়ি নামেই পরিচিত বলে জানালেন বাড়িটির বাসিন্দা অরুণ চৌধুরী। বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটি গাছ আছে, মনে হয় অতিথি বরণ করতেই এমন ডালভরা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে গাছটি। বাড়ির বিশাল পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই দু-একটি হলেও জারুলগাছ চোখে পড়ে। পুকুরপাড়ের অন্য সব গাছের মধ্যে ফুল ফোটায় জারুলগাছগুলোর চেহারা এখন আলাদা।

বাড়িটি অনেক পুরোনো। বাড়ির প্রাচীন পুকুরঘাটটি শতবছরের স্মৃতি ধারণ করে আছে। এ রকম একটি ঘাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অনেক উঁচু একটি জারুলগাছ। বাড়ির দক্ষিণেও অনেক পুরোনো একটি জারুলগাছ দাঁড়িয়ে। শুধু এ দুটি নয়, সব কটি গাছই বয়সে অনেক পুরোনো। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে যখন পুড়ে চরাচর ও হাওরের বুক, তখন জারুল ফুলে ছোঁয়ায় গাছগুলো মায়ায় জড়িয়ে থাকে। বাড়িটির লোকজন কত গাছ আছে আলাদা করে গুনেও দেখেননি। প্রয়োজনও পড়েনি। কেউ তো এগুলো লাগায়নি। তাই গোনাগুনতিরও দরকার পড়েনি। জারুল আপন খেয়ালেই জন্মেছে, ফুটেছেও প্রকৃতির নিয়মে। অরুণ চৌধুরী বললেন, ‘কত গাছ। না গুনে বলার সুযোগ নেই।’

শুধু এ বাড়িতেই নয়, পুরো অন্তেহরি গ্রামটিতেই জারুলের অনেক গাছ। হিজল, বরুণসহ আরও কত বুনো গাছের পাশে মাথা তুলে আছে গ্রীষ্মের উচ্ছ্বাসে থাকা এই ফুল। অন্তেহরি গ্রামটির আশপাশজুড়ে যে কটি গ্রাম, সব কটিতেই এখন জারুলের নিঃশব্দ-নীরব উৎসব। কাউয়াদিঘির হাওরপারে জারুল ফুলের যেন মেলা চলছে। তবে একসময় জারুলের আরও অনেক গাছ ছিল, অন্য রকম কদরও ছিল বলে জানালেন বাড়িটির প্রতিবেশী জ্যোতির্ময় রায়। সেই কদরটা ছিল কাঠের। জারুলের কাঠে নৌকা তৈরি হয়েছে। এখনো হয়, তবে জারুলগাছ যেমন কমে এসেছে। তেমনি ঘরে ঘরে আগের মতো নৌকা বানানোর দরকারও পড়ে না। শুধু টানা বন্যা হলে নৌকা তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে। জ্যোতির্ময় রায় জানালেন, ওই বাড়িতে আগে গাছের বাগান ছিল। প্রচুর জারুলগাছ ছিল। এখনো আছে, তবে তা অনেক কমে গেছে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ কাউয়াদিঘি হাওরপারেরই মানুষ। জারুল ফুল বরাবরই তাঁর কাছে একটি পছন্দের ও ভালো লাগার ফুল। সময়-সুযোগ হলেই হাওরপারের গ্রামগুলোতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজখবর নিতে যেমন তিনি ছুটে যান, ফুলটিও তাঁকে ভীষণ টানে। তাঁর মতে, প্রকৃতিতে এত সুন্দর ফুল আছে। কোনো যত্ন ছাড়াই যে গাছটি বছরের পর বছর টিকে থাকে, একটু পরিকল্পনা করে জারুলের বনায়ন করা গেলে গ্রীষ্মে হাওরপারের চেহারাটা অন্য রকম হয়ে যেত। তাঁর ভাষায়, জারুল গ্রীষ্মের অন্যতম প্রধান ফুল। বেগুনি রঙের ফুলগুলো সেই চৈত্রের শুরুতেই ফুটতে থাকে। থাকেও বর্ষার শুরু পর্যন্ত। ডালে ডালে বেগুনি রঙের ছড়াছড়ি মানুষের নজর তো কাড়ছেই, মনও রাঙাচ্ছে।