নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ, কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে তালা
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে কার্যালয়টিতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ শনিবার দুপুরে কার্যালয়ের প্রধান ফটকে নতুন দুটি তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে সিভিল সার্জনসহ নিয়োগের প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা ভেতরে আটকে পড়েছেন।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সিভিল সার্জন ও অনিয়ম–দুর্নীতিতে জড়িত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাকে (আরএমও) অপসারণ ও নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল না করা হবে, ততক্ষণ তালা লাগানো থাকবে। সিভিল সার্জন শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১১৫টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিভিল সার্জন কার্যালয়। সে সময় ওই নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য সহকারী পদে ৯৭ জন, পরিসংখ্যানবিদ ৩, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান ১, স্টোরকিপার ৪, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ১, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ৫ ও চালক পদে ৪ জন। এসব পদে সব মিলিয়ে আবেদন জমা পড়ে ১৬ হাজার ৭৮৯টি। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় অন্তত আট হাজারের বেশি চাকরিপ্রার্থী অংশ নেন।
অভিযোগ উঠেছে, বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী গত বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত ও গতকাল ভোরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হোসেন ইমামের শহরের বাড়ি ও হাসপাতালের সামনে তাঁর পরিচালিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে জড়ো হন। তাঁদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এতে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করা হয়েছে। এর সঙ্গে সিভিল সার্জনসহ আরও অনেকে জড়িত রয়েছেন। গতকাল ভোরে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার বাড়ি ও ক্লিনিক থেকে চাকরিপ্রার্থী নারী–পুরুষদের বের হতে দেখা গেছে। এমন কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে শহরজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাবেক সদস্যসচিব মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ১৫–২০ লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা ভিডিওতে দেখেছি, পরীক্ষার এক দিন আগে আরএমওর বাড়ি ও ক্লিনিকে চাকরিপ্রার্থীদের অ্যাম্বুলেন্সে এনে রাখা হয়েছে। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে। এই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করতে হবে।’
ভিডিওতে দেখা যায়, গতকাল সকালে কিছু চাকরিপ্রার্থী আরএমও হোসেন ইমামের কালিশংকরপুর এলাকার বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। স্থানীয় সাংবাদিকেরা এ সময় কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ দৌড়ে চলে যান। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রাতে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে কয়েকজন পরীক্ষার্থী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসেন। সেখানে সাংবাদিকেরা গেলে কৌশলে পালিয়ে আবার একই এলাকায় আরএমওর বাসায় যান তাঁরা।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কয়েকজনসহ চাকরিপ্রার্থী ও তাঁদের কয়েকজন অভিভাবক শহরের এন এস রোডে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। তাঁরা পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা বেলা ১টা ৩৩ মিনিটের দিকে নতুন দুটি তালা এনে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান ফটকে লাগিয়ে দেন। বিক্ষোভকারীরা জানান, তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তালা লাগিয়েছেন। ভেতরে আটকা পড়েছেন সিভিল সার্জন ও নিয়োগ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভে থাকা স্বাস্থ্য সহকারী পদে অংশ নেওয়া রাসেল রানা নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে। টাকা নিয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য করা হয়েছে। এটা জানার পর প্রতিবাদ জানাতে আসছি। এই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে।’
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত ছাত্র–জনতা সিভিল সার্জন ও আরএমওর নাম উল্লেখ করে স্লোগান দিতে থাকেন। এক অভিভাবক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার দুই ছেলে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষা দেওয়ার পর রাতে জানাল পরীক্ষায় অনিয়ম হয়েছে। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আসছি।’
আন্দোলনে অংশ নেওয়া আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য সুলতান মারুফ তালহা বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়োগ বাতিল করা না হবে, ততক্ষণ তালা লাগানো থাকবে। সেই সঙ্গে সিভিল সার্জন ও আরএমওর অপসারণ চাই। আর এত বড় দুর্নীতির পরও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক ঘুমাচ্ছেন। তাঁর কাছেও জবাবদিহি চাই।’
বিক্ষোভকারীরা তালা দেওয়ার আগে দুপুর ১২টার দিকে সিভিল সার্জন শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পাঁচ সদস্যের কমিটি আছে। সেখানে তিনি সদস্যসচিব। পরীক্ষার আগের রাতে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি কক্ষে সব সদস্য মিলে প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। প্রশ্নপত্র ফটোকপিসহ বিভিন্ন কাজে আরও কয়েকজন ছিলেন। যাঁরা প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবার ফোন ক্লোজ করে রাখা হয়। প্রশ্নপত্র বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল সকাল আটটার পর প্রশ্নপত্র কেন্দ্রগুলোয় পাঠানো হয়। আর আরএমও নিয়োগ–সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে জড়িত নন। যে অভিযোগ আসছে, তা পুলিশ তদন্ত করতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও হোসেন ইমাম বলেন, তাঁর বাসায় বিভিন্ন নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা মেস ভাড়া করে থাকেন। সেখান থেকে এসব শিক্ষার্থীকে বের হতে দেখে অনেকে বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তিনি ওই নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে কিছু জানেন না।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে পুলিশ রয়েছে। এ ছাড়া হয়তো সিভিল সার্জন পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন, এজন্য বেলা একটার দিকে সিভিল সার্জন প্রাঙ্গণের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ রয়েছে।
শনিবার বিকেল পাঁচটায় শহরের কালিশংকুর এলাকায় আরএমও হোসেন ইমামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চার তলা বাড়ির নিচ তলাতে ছেলেদের মেস। মেসে ১০ জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে সাত জন ম্যাটসে পড়াশোনা করেন। বাকিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শুক্রবার ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে যেসব চাকরিপ্রার্থীদের দেখা গেছে তাঁদের কেউ–ই সেখানে থাকেন না বলে নিশ্চিত করেন মেসের পরিচালক আমিনুল ইসলাম।
ভবনের দ্বিতীয় তলায় হোসেন ইমাম পরিবার নিয়ে থাকেন। তৃতীয় তলা ভাড়া দেওয়া। চতুর্থ তলাকে মেয়েদের মেস। ওই মেসের এক মেয়ে শিক্ষার্থী জানান, চতুর্থতলায় দুটি ফ্লাটে ১৪ জন সদস্য থাকেন। শুক্রবারের ঘটনার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় থাকা কমিটির এক সদস্য প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, শুক্রবার রাতেই বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, ঘটনার তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হোক। তদন্ত শেষে যদি অনিয়মের কোনো সত্যতা না পাওয়া যায় তবে খাতা দেখা এবং ফলাফল ঘোষনার কাজ চালাবেন। তার আগে সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কমিটির চার সদস্যই কুষ্টিয়াতে আছেন। শুধুমাত্র সিভিল সার্জন তাঁর কার্যালয়ে রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরীক্ষার খাতাসহ সব কিছু সিভিল সার্জন কার্যালয়ে রয়েছে। সেগুলো জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু সিভিল সার্জন কার্যালয় তালা লাগানো থাকায় সেটা করা যাচ্ছে না।