বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, ক্লাস মন্দিরের কক্ষে 

গত নভেম্বর মাস থেকে মন্দিরের দুটি কক্ষে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যালয় ভবনের ছাদ থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা। বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা। গত বুধবার দুপুরে তোলাছবি: দিনার মাহমুদ

লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রমের মাইকে গীতা পাঠ করছেন পুরোহিত। ঢোল-ঢাক ও কাঁসরের টুংটাং শব্দ। সেই শব্দের মধ্যেই পাশের মন্দিরের দাপ্তরিক কাজের দুটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বারবার ক্লাসরুমের বাইরে চলে যাচ্ছিল। শিক্ষক টেবিলে ডাস্টার চাপিয়ে শব্দ করে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন। 

গত বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ শ্রীশ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর মন্দিরের দাপ্তরিক কক্ষে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানোর সময় এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। 

মন্দিরের ১০০ গজ দূরে অবস্থিত ২৬ নম্বর লক্ষ্মীনারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২৭ নম্বর লক্ষ্মী নারায়ণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুটি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলে একটি  ভবনে। ছাদের পলেস্তারা ও বিমের ঢালাই খসে পড়লে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। গত নভেম্বর মাস থেকে মন্দিরের দুটি কক্ষে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। 

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ঝিমি সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুল তো স্কুলই। মন্দিরে তো স্কুলের পরিবেশ পাওয়া যাবে না। শব্দদূষণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করানো খুবই কষ্টকর।’ 

স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মন্দিরের ভবনের দুটি কক্ষে তিন মাসের জন্য ক্লাস করতে দেওয়া হয়েছে। তিন মাস পর বাচ্চারা কোথায় ক্লাস করবে, তা আমরা জানি না।
তাপসী সাহা, প্রধান শিক্ষিকা, লক্ষ্মী নারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

সরেজমিন দেখা গেছে, শহরের দেওভোগ আখড়ার মোড় এলাকায় ২৬ নম্বর লক্ষ্মীনারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২৭ নম্বর লক্ষ্মী নারায়ণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৪ শতাংশ জমির ওপর ১৯৩৯ সালে একসঙ্গে দুটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। 

ভবনের নিচতলা ও দোতলা মিলে কক্ষের সংখ্যা ছয়টি। দোতলায় বাঁপাশের কক্ষের ছাদের বিমের ঢালাই ও পলেস্তারা খসে পড়েছে। ছাদটি যাতে ধসে না পড়ে, এ কারণে চারটি বাঁশ লাগিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। 

ভবনের অন্য দুটি কক্ষের ছাদ ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। এ কারণে ভবনের দোতলার তিনটি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনটি কক্ষ কোনোমতে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি কক্ষে পাঠদান করা হয়। একটি কক্ষে শিক্ষকেরা বসেন। দোতলায় বাথরুম, কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে পড়ায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শিক্ষকদের কক্ষে একটি বাথরুম আছে। বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের সেটি ব্যবহার করতে হয়।

বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই পালায় সাতজন করে নিয়োজিত থাকেন। দুজন প্রধান শিক্ষক। প্রথম পালা সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস, দ্বিতীয় পালায় দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে বালক বিদ্যালয়ের ক্লাস। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৬০০। ভবন বেহালের কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। 

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে পাশের মন্দির ভবনের দুটি কক্ষে পঞ্চম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা অভিভাবক বীথি আক্তার বলেন, স্কুলের ক্লাসের ছাদের ঢালাই খসে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের তিনটি ক্লাসরুম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারা স্কুলে ক্লাস করতে পারছে না। 

লক্ষ্মী নারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তাপসী সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মন্দিরের ভবনের দুটি কক্ষে তিন মাসের জন্য ক্লাস করতে দেওয়া হয়েছে। তিন মাস পর বাচ্চারা কোথায় ক্লাস করবে, তা আমরা জানি না।’

বিদ্যালয়ের নামে ৪ শতাংশ জমি থাকলেও তা দখলে নেই বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মী নারায়ণ বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান নুরুন নাহার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের দখলে পৌনে ৩ শতাংশ জমি রয়েছে। বাকি জমি বেদখল হয়ে গেছে। জমি নিয়ে স্কুলের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। একটি মামলায় স্কুলের পক্ষে রায় এসেছে, কিন্তু প্রতিপক্ষ বারবার সময় চেয়ে কালক্ষেপণ করায় নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। 

জরাজীর্ণ অকেজো ভবনের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাঘাত হচ্ছে বলে জানান বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাহবুবুল আলম। এ বিষয়ে তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। 

জায়গা নিয়ে মামলা জটিলতার কারণে নতুন ভবনের নকশা তৈরির কাজ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌসী বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আদালতের রায় পেলেই স্কুলের জায়গা দখলে নিয়ে নতুন ভবন নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আসলে বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছেন জায়গাটি তাঁদের নয়। শিক্ষা প্রকৌশলী বিভাগের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।