পাহাড়ের দলগুলোর মধ্যে কেবল জেএসএস নির্বাচনমুখী, তৎপরতা নেই বাকি তিন দলের
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় দেশের বড় দল ছাপিয়ে আলোচনায় থাকে আঞ্চলিক দলগুলো। তিন জেলায় ভোটের মাঠে দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে এবার কেবল রাঙামাটিতে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নির্বাচনে এলেও বাকি দুই জেলায় এখনো কোনো দলের তৎপরতা নেই।
পাহাড়ে জেএসএস ছাড়াও আরও তিনটি আঞ্চলিক দল রয়েছে—জেএসএস (এম এন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
গতকাল মঙ্গলবার রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খানের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেএসএসের সহসভাপতি উষাতন তালুকদার। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনিই জয়ী হবেন। আর নির্বাচিত হলে এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন।
জেএসএসের নেতা-কর্মীরা বলছেন, রাঙামাটির বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় জেএসএসের সমর্থন রয়েছে। এর ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে জেএসএসের লড়াই হবে।
দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ ও জেএসএসের মধ্যে বিরোধ পুরোনো। কয়েক বছরে সেই বিরোধ আরও বেড়েছে। অথচ ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জেএসএসের সমর্থনে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেএসএসের টানাপোড়েন দেখা দেয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেই বিরোধ তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জেএসএস বিএনপির প্রার্থী মনি স্বপন দেওয়ানকে সমর্থন দেয়। এতে জয়ী হন মনি স্বপন দেওয়ান।
জেএসএসের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সহসভাপতি উষাতন তালুকদার নির্বাচিত হন। ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে। সে বছর বিএনপি ভোট বর্জন করেছিল।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নানা নাটকীয়তা তৈরি হয়েছিল। ইউপিডিএফ সমর্থন দিয়েছিল জেএসএসকে। আর জেএসএস–এম এন লারমার সমর্থন পায় আওয়ামী লীগ। এতে ভোটের লড়াইটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল জেএসএস ও আওয়ামী লীগের মধ্যে। পরে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। হেরে যান উষাতন তালুকদার। সে সময় জেএসএস অভিযোগ করেছিল, কারচুপি করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনে জিতেছিলেন।
রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দীপংকর তালুকদার। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। জেএসএস (এম এন লারমা) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। ইউপিডিএফ নির্বাচনে আসছে না। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী হারুনুর রশীদ মাতুব্বর মনোনয়নপত্র এখনো জমা দেননি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাঙামাটি আসনে ভোটার তালিকা হালনাগাদের পর বর্তমানে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১৭ জন ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৪৪ পুরুষ ও ২ লাখ ১৮ হাজার ৩৭৩ জন নারী।
দুই জেলায় অন্য রকম পরিবেশ
খাগড়াছড়িতে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। আজ বুধবার তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়েছিলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন খাগড়াছড়ি আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও পানছড়ি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা এবং জাতীয় পার্টির সোলাইমান আলম শেঠ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই—এই অভিযোগে নির্বাচনে যাচ্ছে না ইউপিডিএফ। দলের অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশে বর্তমান সাংবিধানিক সংকট ও গণতন্ত্রহীনতা এ সত্যতার প্রমাণ দেয়। এ কারণে নির্বাচনে যাচ্ছে না ইউপিডিএফ।
অন্যদিকে জেএসএস (এম এন লারমা) এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে সরাসরি কোনো বিবৃতি দেয়নি। দলীয় সূত্র বলছে, তাদের কেউ এবারও নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ ছাড়া ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) কোনো কিছুই জানায়নি।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, খাগড়াছড়িতে গতবারের চেয়ে এবার ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। এবারের ভোটারসংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৩৪৬। এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৫৩ হাজার ২৮৫, পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬২ হাজার ৬১ জন।
এদিকে বান্দরবান জেলায় এবারও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বীরবাহাদুর উশৈসিং। তিনি ছয়বারের সংসদ সদস্য। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মংওয়ে প্রু। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন এ টি এম শহীদুল ইসলাম। আজ এ টি এম শহীদুল ইসলামের মনোনয়নপত্র নেওয়ার কথা রয়েছে।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক জলিমং মারমার অভিযোগ, বান্দরবানে জেএসএসের নেতা-কর্মীরা মামলা ও হামলায় ঘরবাড়িছাড়া হয়েছেন। তিন–চার বছর ধরে আত্মগোপনে আছেন। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করার জন্য আতঙ্ক ও দমন-পীড়নে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বান্দরবানে শুধু সংসদ নির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচন করার জন্যও জেএসএসের পক্ষে পরিবেশ নেই। খাগড়াছড়িতেও প্রায় একই অবস্থা।