মারমাদের মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব যে কারণে হয়, যেভাবে এল
মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে ‘মৈতা রিলং পোয়ে’ বা মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব। এই উৎসবে পরস্পরের দিকে পানি ছিটিয়ে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন মারমারা। ‘সাংগ্রাইংমা ঞি ঞি ঞা ঞা রিকোজাই পামে’(এসো হে সাংগ্রাইংয়ে সবাই মৈত্রী পানিবর্ষণে) গানটিও দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আছে এই উৎসবের ‘থিম সং’।
গবেষক ও মারমা জনগোষ্ঠীর প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসবের শুরু গত শতকের সত্তরের দশকে। কিছু তরুণ মিয়ানমারে সাংগ্রাইং উৎসবে এ ধরনের আয়োজন দেখে দেশেও এর প্রচলন করেন। আর ‘সাংগ্রাইংমা ঞি ঞি ঞা ঞা রিকোজাই পামে’ উৎসবের থিম সং হয়েছে ১৯৮৪ সালে।
মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসবকে অনেকেই ‘জলকেলি’ ও ‘পানি খেলা’ বলে থাকেন। তবে এসব নাম আপত্তিকর বলে মনে করেন মারমা সমাজের অনেকেই। তাঁদের দাবি, এর মধ্য দিয়ে ধর্মের যোগ থাকা অনুষ্ঠানটি ভুলভাবে উপস্থাপন হয়।
এবারের সাংগ্রাইং উপলক্ষে আজ বুধবার থেকে বান্দরবান জেলা শহরে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব শুরু হয়েছে। তবে জেলার অন্যান্য জায়গায় গতকাল মঙ্গলবার এই উৎসব শুরু হয়। খাগড়াছড়িতে কোথাও কোথাও সোমবার শুরু হয়েছে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব।
মারমা জনগোষ্ঠীর প্রবীণদের একজন শিক্ষাবিদ থোয়াইংচ প্রু। তিনি প্রথম আলকে বলেন, সাংগ্রাইং আখ্যেয়া বা মূল সাংগ্রাই দিনে বুদ্ধমূর্তি স্নানের আগে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব হয় না। এটা প্রথাসিদ্ধ রীতি। তাই মৈত্রী পানিবর্ষণের সঙ্গে ধর্মের যোগ বেশ স্পষ্ট। তিনি বলেন, পানিকে মারমারা পবিত্র মনে করে। তাই সাংগ্রাইং উৎসবে বন্ধুত্বের বন্ধন এবং পরস্পরের প্রতি মৈত্রী ভাবনা নবায়ন ও সুদৃঢ় করার জন্য একে-অপরের দিকে পানি ছোড়েন। পানি ছিটানোর পর কেউ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালে বোঝা যাবে, বন্ধুত্বের সম্পর্কে ও বন্ধনে টানাপোড়েন আছে। এটিই মৈত্রী পানিবর্ষণের মূল্যবোধ। এ কারণে অনেক সময় অযাচিত কাউকে পানিবর্ষণ করলে আগে সালিসের মুখোমুখিও হতে হতো।
মারমা ভাষার লেখক ও গবেষক মংক্য শোয়েনু মারমা বলেন, মৈত্রী পানিবর্ষণ জলকেলি বা পানিখেলা নয়। এটি পারস্পরিক হৃদ্যতা ও মৈত্রী বন্ধনের মূল্যবোধ থেকে করা হয়। আগে আনুষ্ঠানিক মৈত্রী পানিবর্ষণ হতো না। বাড়িতে চেনাজানা তরুণ-তরুণী, সমবয়সী ও বন্ধুবান্ধব পরস্পর পবিত্র পানিতে সিঞ্চিত হতেন। অসম বয়সী হলে অনুমতি নিয়ে পানি ছিটানো যেত। তবে অনুমতি না নিয়ে পানি ছিটালে অসৌজন্যমূলক হিসেবে বিবেচিত হয়। মংক্য শোয়েনু আরও বলেন, আগে সাংগ্রাইং উৎসবে বুদ্ধমূর্তি স্নান অনুষ্ঠানের পর বৌদ্ধবিহারে অষ্ট শীলধারী বয়স্ক ব্যক্তিদের ভক্তি-শ্রদ্ধায় স্নান করানো হতো। তরুণ-তরুণীরা প্রবীণদের স্নান করাতেন। বয়স্করা সামর্থ্য অনুযায়ী তরুণ-তরুণীদের টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। ওই টাকা এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে তোলা চাঁদার টাকা দিয়ে পিঠা তৈরি করতেন।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট বান্দরবানের সাবেক পরিচালক মং নু চিং মারমার মতে, ১৯৭৩-৭৪ সালে কিছু যুবক মিয়ানমারে ঘুরে আসেন। সেখানে তাঁরা সাংগ্রাইংয়ে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব আয়োজন দেখেছেন। সেই দেখা থেকে বান্দরবানে ফিরে ১৯৭৪ সালে তাঁদের উদ্যোগে মহকুমা শহরে প্রথম মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব আয়োজন করা হয়। পরবর্তী সময়ে নানা কারণে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বান্দরবান জেলা সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ক্যসামং মারমা বলেন, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ধারাবাহিকভাবে মৈতা রিলং পোয়ে হয়ে আসছে। সেই সময়ে ‘সাংগ্রাইংমা ঞি ঞি ঞা ঞা-সাংগ্রাইং’ উৎসবের থিম সংগীত করা হয়। ‘সাংগ্রাইং মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুরু হয়েছে পার্বত্য চুক্তির পর। শুরুতে ‘বৈসাবি শোভাযাত্রা’ নামে এটি করে আসছিল ছাত্রসমাজ।
মারমা শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান চথুই ফ্রুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাংগ্রাইং উৎসবের সংগীত ১৯৮৪ সালে হয়েছে। গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন প্রয়াত উপঞা জোত মহাথের। এই গান একই সঙ্গে সাংগ্রাইং ও মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসবের থিম সং হিসেবে বিবেচিত। মৈত্রী পানিবর্ষণ অনুষ্ঠানে এই গানের সুরে তরুণ-তরুণীরা মেতে ওঠেন। এটি ছাড়া বর্তমানে সাংগ্রাইং উৎসব কল্পনাও করা যায় না।