১৭ গুণ বেশি দামে কেনা জমিতে পড়ে আছে ভবন

বাজারমূল্যের চেয়ে জমির দাম প্রায় ১৭ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। প্রকল্প এলাকাটি মাগুরা জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে।

মাগুরা-নড়াইল আঞ্চলিক সড়কের পাশে নবগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে প্রফুল্ল-প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্যকেন্দ্র। ৩ ডিসেম্বরছবি: প্রথম আলো

১৭ গুণ বেশি দামে জমি কেনা হয়েছে। সেই জমির ওপর নির্মিত হয়েছে পাঁচতলাবিশিষ্ট সুদৃশ্য দুটি ভবন। সাবেক এক অতিরিক্ত সচিব মাগুরায় নিজের মা–বাবার নামে ট্রাস্ট গঠন করে প্রবীণ নিবাস ও এতিমখানার জন্য ভবন দুটি নির্মাণ করেছেন। পাঁচ মাস আগে ভবনগুলোর কাজ শেষ হলেও এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে। অনেকে একে সরকারি টাকার অপচয় বলছেন।

প্রফুল্ল-প্রতিভা ট্রাস্ট ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যয়ের ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ট্রাস্টের দেওয়ার কথা। বাকি ২২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা সরকার দিয়েছে। কিন্তু কাজের শুরুতে জমি কেনার নামে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সাবেক ওই অতিরিক্ত সচিবের নাম স্বপন কুমার ঘোষ (৬২)। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রকল্প দেখভাল করতে পরিকল্পনা কমিশনের যে আর্থসামাজিক শাখা আছে, ২০২০ সালের মার্চে তিনি ওই শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। পরে নিজ জেলা মাগুরার সদর উপজেলার শত্রুজিৎপুর ইউনিয়নের পয়ারী গ্রামে মা–বাবার নামে প্রফুল্ল-প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে প্রফুল্ল-প্রতিভা ট্রাস্ট। স্বপন কুমার ঘোষ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং তাঁর স্ত্রী ছবি রানী কর ট্রাস্টের পাঁচ সদস্যের একজন। প্রকল্পের আওতায় দুটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে একটি ভবনে ৫০ এতিম ও আরেক ভবনে ৫০ জন প্রবীণ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকতে পারবেন। গত জুনে ভবন নির্মাণসহ প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন হলেও এখনো চালু হয়নি।

প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে শত্রুজিৎপুর ইউনিয়নের পয়ারী গ্রামের ১৭৭ নম্বর মৌজায় ১২৭ শতক জমি দেওয়ার কথা প্রফুল্ল-প্রতিভা ট্রাস্টের। প্রকল্প পরিচালকের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতি শতক জমির দাম ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ধরে ১২৭ শতক জমির জন্য ৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আদতে ওই এলাকায় জমির দাম অনেক কম।

শত্রুজিৎপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের ১২৭ শতক জমির মধ্যে বাগান শ্রেণীর ১১১ শতক। সরকারি মৌজা মূল্য হিসেবে ওই এলাকায় বাগান শ্রেণীর প্রতি শতক জমির সর্বনিম্ন মূল্য ২৩ হাজার ৪৬ টাকা। এই হিসেবে ১১১ শতক জমির মূল্য ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ১০৬ টাকা। আর ১৬ শতক জমি আছে ডাঙ্গা শ্রেণীর। সরকারি মৌজা মূল্য হিসেবে ওই এলাকায় ডাঙ্গা শ্রেণীর প্রতি শতক সর্বনিম্ন মূল্য ১৪ হাজার ৮০০ টাকা। সেই হিসেবে ১৬ শতক জমির মূল্য ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ টাকা। সব মিলিয়ে ১২৭ শতক জমির দাম দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ৯০৬ টাকা। কিন্তু এই দামের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি দামে ৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে ওই জমি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ৯ মাস প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছি। এটা মন্ত্রণালয় থেকে আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে।’

পাড়াগাঁয়ে প্রবীণ নিবাস

মাগুরা শহর থেকে পয়ারী গ্রামের দূরত্ব আনুমানিক ১৫ কিলোমিটার। শহর থেকে নড়াইল আঞ্চলিক সড়ক ধরে গেলে প্রথমে শত্রুজিৎপুর বাজার পড়ে। বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা পার হলে চোখে পড়ে পাশাপাশি দুটি নতুন ভবন। এর একপাশে মাগুরা-নড়াইল আঞ্চলিক সড়ক, অন্যপাশে নবগঙ্গা নদী।

৩ ডিসেম্বর সরেজমিনে ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পাঁচতলা দুটি ভবন চোখে পড়ে। ভবন দুটির ফটকে তালা। তবে কোথাও প্রকল্পের নির্মাণ–সংক্রান্ত তথ্যবোর্ড চোখে পড়েনি। প্রকল্পের অংশ হিসেবে নবগঙ্গা নদীতে নামার জন্য বড় একটি ঘাট করা হয়েছে। বিকেলে সেখানে বসে স্থানীয় বাসিন্দারা সময় কাটান। প্রকল্পের আশপাশে এমন ভবন আর নেই বলে জানালেন তাঁরা। 

জানতে চাইলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বপন কুমার ঘোষ গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় ১০০ বার এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। ডিপিপি আছে। ওখানে সব লেখা আছে। কী উপকার হবে, কীভাবে হয়েছে। সব লেখা আছে। আমি আর বলতে পারব না।’

ভবন দুটির আশপাশে বাড়ি আছে এমন অন্তত পাঁচজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, এখানে তিন বছর আগেও জঙ্গল ছিল। দুই বছর আগে এখানে ভবনের কাজ শুরু হয়। তারপর তরতর করে দুটি ভবন উঠে যেতে দেখেছেন তাঁরা। তবে শুরু থেকে ওখানে কোনো বৃদ্ধ বা এতিম নিবাসীকে দীর্ঘদিন থাকতে দেখেননি কেউই।

মাগুরার এই ট্রাস্ট নিয়ে তাঁরাও আলোচনা করেছেন জানিয়ে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহফুজুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রবীণ নিবাসে মানুষ থাকতে চায় না। শহরের বাইরে মানুষ যাবে কি না সেটাও বড় প্রশ্ন। প্রকল্পে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে কি না সরকারের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।