একসঙ্গে চলতেন-ফিরতেন, শেষ শয্যায়ও পাশাপাশি

থামছে না মোহাম্মদ আজমের মায়ের আহাজারি। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আজিম পাড়ায়
ছবি: এস এম ইউসুফ উদ্দিন

ছোটবেলায় একসঙ্গে পড়েছেন স্কুলে। সেই থেকেই দুই বন্ধু আর কখনো আলাদা হননি। গ্রামের হাটবাজারে কি, চা–দোকানে একসঙ্গে দেখা যেত তাঁদের। কাজ শেষে দুই বন্ধু প্রতি রাতে আড্ডা দিয়ে যে যাঁর ঘরে ফিরতেন। একজনের বাড়ির ৩০০ মিটার দূরেই থাকতেন অন্যজন। তবে এখন সে দূরত্ব ঘুচে গেছে। পাশাপাশি কবরে শেষ শয্যা হয়েছে দুই বন্ধুর।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আজিমপাড়ার বাসিন্দা দুই বন্ধু মোহাম্মদ আরাফাত (২৮) ও মোহাম্মদ আজমকে (২৮) মৃত্যুও আলাদা করতে পারেনি। নিহত আরাফাত স্টিল আলমারির দোকানের কারিগর ছিলেন। আর আজম ছিলেন সিএনজি অটোরিকশা চালক। গতকাল সোমবার নিজের বিয়ের কেনাকাটা করে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আরাফাত। তাঁকে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। আরাফাতের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন মোহাম্মদ আজম। ওই দিন দুপুরে বন্ধুর কবর খুঁড়তে গিয়ে শোকে কাতর আজম কবরের ওপর পড়েই জ্ঞান হারান। সে অবস্থায় তাঁকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল বিকেলে চমেক হাসপাতালে তাঁকেও মৃত ঘোষণা করা হয়।


গ্রামের মসজিদের মাঠে গতকাল আসরের নামাজের পর জানাজা হয় আরাফাতের। আর এশার নামাজের পর আজমের। পাশাপাশি দুটি কবরে দাফন করা হয় তাঁদের। দুই বন্ধুর অকাল মৃত্যু পুরো গ্রামের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। বাজারে, চা–দোকানে আজ মঙ্গলবার দুই বন্ধুর মৃত্যু নিয়েই চলছিল আলোচনা।

মোহাম্মদ আজম (বাঁয়ে) ও মোহাম্মদ আরাফাত
ছবি: সংগৃহীত

হবু বউকে আংটি পরিয়েছিলেন আরাফাত

মুহাম্মদ আরাফাতের বিয়ের দিন ধার্য হয়েছিল আগামী ৫ অক্টোবর। হবু বউয়ের হাতে তিনি নিজে গত শুক্রবার আংটি পরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। বিয়ের জন্য কেনা হয়েছিল নানা সরঞ্জামও। কথা ছিল গতকাল সোমবার বিকেলে সেগুলো নিয়ে হবু শ্বশুরবাড়ি যাবেন। সঙ্গে বন্ধু আজমেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুজনই এখন এসবের অতীত। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল দুই বন্ধুকে।

তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে আরাফাত সবার বড় আর পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে আজম সবার ছোট। আজমের সংসারে স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। আরাফাতের পরিবারের সদস্যরা জানান, আট বছর আগে তাঁর বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। পরিবারের সব দায়দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে তখন থেকেই। স্টিলের আলমারি তৈরির কাজ শিখেছেন সংসার চালাতে। কারিগর হয়ে ধরেন পরিবারের হাল। তিন বছর আগে বিয়ে দেন দুই বোনের। আমিরাতের দুবাইতে পাঠান ছোট ভাই মুহাম্মদ সিফাতকে (২১)।  তবু নিজের সংসার হলো না। সুখের মুখ দেখার আগেই চলে গেলেন।

আরাফাতের বাড়িতে বসে এসব কথাই বলছিলেন ছোট ভাই মুহাম্মদ রিফাত ও বোন রেনু আকতার। তাঁর মা আকতার বেগম শোবার ঘরে বিছানায় পড়ে আছেন। সেখান থেকে বের হননি সকাল থেকে। ছেলের শোকে বাক্যহারা তিনি।

আজ দুপুরে আরাফাতের বাড়িতে গিয়ে চাপা শোকের পরিবেশ দেখা গেল। ওই বাড়ির ৩০০ মিটার দূরেই আজমের বাড়ি। সেখানে ঢুকতেই দেখা গেল ১০ থেকে ১২ জন নারীর জটলা। তাঁদের সঙ্গে দেখা গেল আজমের দুই শিশুকন্যা জান্নাতুল মাওয়া (৩) ও তায়েবা আকতারকে (১)। দুই শিশুর মা আজমের স্ত্রী জেসমিন আকতার (২৫) চোখের জল ফেলে যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে।

মুহাম্মদ আজমের বোন জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ভাইয়ের স্ত্রী জেসমিন আকতার দুই মেয়ে নিয়ে দিশাহারা। পিবারের সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। দুই শিশু নিয়ে ভাইয়ের বউ কোথায় যাবে, জানেন না তাঁরা।

গ্রামের পাশের শায়েস্তা খাঁ বাজার। চা–দোকানে বসে প্রবীণ ব্যক্তি আহমদ আলী বলেন, এলাকার দুটি ছেলে একজনের শোকে আরেকজন মারা গেল, এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। এই মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক।