সংগ্রামী এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন সকালে ঘরের কাজ শেষ করে বাড়ির সামনে শুরু করেন খাঁচা তৈরির কাজ। পাশে বসে বাঁশের কাঠির জোগান দেন স্বামী ও ছেলে। মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে কাজে যোগ দেন তাঁর ভাগনে আবুল হোসেন (৪৫) ও আবদুর রহিম (৪১)।
পাঁচজনের গল্পের তালে জোছনা বেগম খাঁচার ফ্রেমে একটার পর একটা বাঁশের কাঠি গাঁথেন। পড়ন্ত বিকেলে সেখানে আসেন পাড়ার অন্য নারীরা। একদিকে চলে গল্প, অন্যদিকে জোছনা বেগমের হাত ঘুরে বেড়ায় বাঁশের কাঠির ফ্রেমে। গল্পে গল্পে এভাবেই ১৪–১৫টি গোলাকৃতির খাঁচা বোনেন তিনি।
জোছনা বেগমের বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার হরেকৃষ্টপুর ইসলামপাড়ায়। অসুস্থ স্বামী, ছেলে, ছেলের স্ত্রী–সন্তানকে নিয়ে অভাবের সংসার তাঁর। তিন শতক জমিতে টিনের বেড়া ও ছাউনির নড়বড়ে ঘর। দিনশেষে খাঁচা বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই ঘোরাতে হয় সংসারের চাকা।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে মনে করেন জোছনা বেগম। সারা দিনে ২০টি করে টোপা তৈরি করেন জানিয়ে সংগ্রামী এই নারী বলেন, কখনো গ্রাম থেকে আবার কখনো স্থানীয় বাজার থেকে বাঁশ কিনে আনেন ছেলে আলমগীর। প্রতিটি বাঁশ ২০০ থেকে ২১০ টাকা। একটি ভালোমানের বাঁশ থেকে পাঁচ-সাতটি খাঁচা তৈরি হয়। বিরামপুরের চাঁদপুর, পলিখাপুর, কেটরা, আয়ড়া, দেশমা, হাকিমপুরের ডাঙাপাড়া, ফুলবাড়ী, পার্বতীপুরের আমবাড়ী থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে ৯০ থেকে ১১০ টাকা দরে এসব খাঁচা কিনে নিয়ে যান। আর এগুলো বিভিন্ন হাটে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
জোছনা বেগমকে অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন মুকুন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন পিছিয়ে পড়া নারী হয়েও জোছনা বেগম সংসারের হাল ধরছেন, নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলছেন। ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতার সুযোগ থাকলে তাঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মোশাররত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর দপ্তর থেকে জোছনা বেগমের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাঁরা যদি একটি সমিতি গঠন করে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে সেই সমিতিকে নিবন্ধনের বিষয়ে সহযোগিতা করা হবে। সমিতির নিবন্ধন হলে প্রতিবছর একটি আর্থিক অনুদান পাওয়ার সুযোগ থাকবে।’
খাঁচা বোনার ফাঁকে কথা হয় জোছনা বেগমের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে (প্রায় ৩০ বছর ধরে) স্বামীকে খাঁচা বোনার কাজে সহযোগিতা করেছি। অসুস্থতার কারণে তিনি আর আগের মতো খাঁচা বুনতে পারেন না। তাঁরা বাপ-বেটা আমাকে কাঠি তুলে দেন। আর আমি এখন খাঁচা বুনি। খাঁচা বেচে যা আয়, তা দিয়েই কষ্টে দিন পার করি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা সমাজসেবা দপ্তর, উপজেলা মহিলাবিষয়ক দপ্তর ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। জোছনা বেগম উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।