ছোট ছোট উদ্যোগে আসছে সফলতা

বর্তমানে দিনাজপুর শহরে ৩৫ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজ করেছেন। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১৩ হাজার ৮৪৭টি মামলা করা হয়। 

কৃষক বাবার ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে আশিকুরের বায়না ছিল একটি বাইসাইকেলের। বাবা আবদারও পূরণ করেছিলেন। বাইসাইকেল পেয়ে আশিকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না। কখন স্কুলে যাবে, বন্ধুদের দেখাবে নতুন বাইসাইকেল। সেই সাইকেল বন্ধুদের দেখাতে পারেনি আশিকুর। বিদ্যালয়ের যাওয়ার পথে সিমেন্টবোঝাই ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় তার। স্কুলে যাওয়া হলো না, রাস্তায় পড়ে থাকল ব্যাগ, বই আর নতুন সাইকেলটি। 

চলতি বছরের ৮ মার্চ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা শহরের রেলস্টেশন রোডে এ ঘটনা ঘটে। ওই উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আশিকুরের মতো ১৮ জন প্রাণ হারান। সড়ক দুর্ঘটনার এসব বিষয় ভাবিয়ে তোলে চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রশিদকে। আশিকুরের মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়া দেয় তাঁকে। এরপর থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। 

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা বাড়াতে আজ ২২ অক্টোবর সারা দেশে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় রাখা হয়েছে, ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’। দিবসটি পালন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, বিআরটিএ ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) শোভাযাত্রা ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে। বেলা তিনটায় নিসচা শহরের গোড়-এ-শহীদ বড় মাঠ থেকে শহরব্যাপী হেলমেট শোভাযাত্রা বের হবে।

চিরিরবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উপজেলায় ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ১৪ জন। এসব সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে নিবন্ধনহীন ইট ও বালুবাহী ট্রাক্টরের সঙ্গে মোটরসাইকেল আরোহীর। উপজেলা শহরের প্রবেশমুখ ঘুঘরাতলী মোড় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

ওসি বজলুর রশিদ বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ থানায় যোগ দেন। এর আগে দিনাজপুর সদর থানায় চাকরি করেছেন, ফলে চিরিরবন্দর যে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয় তা তিনি জানতেন। উপজেলায় এসে দুর্ঘটনা রোধে কাজও শুরু করেন। তবে আশিকুরের মৃত্যুর পরে মর্মাহত হয়ে পড়েন। এরপর ১৩ মার্চ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং কঠোরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। 

ওসি আরও বলেন, চিরিরবন্দর উপজেলা ইটভাটার সংখ্যা ৩৮টি এবং বালুমহাল আছে ৫টি। আর মালবাহী ট্রাক্টরের সংখ্যা দেড় শতাধিক। উপজেলা থেকে এসব ইটভাটার ইট ও বালু পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলোর বেশির ভাগই অনিবন্ধিত। চালকও অদক্ষ। তিনি ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে সমন্বয় করে এসব ভাটামালিক, ট্রাক্টরচালকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। সভায় সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শহরের ওপর দিয়ে এসব মালবাহী ট্রাক্টর চলাচল করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১০ মার্চ ঘুঘরাতলী মোড়ে ট্রাফিক বক্স স্থাপন করেন। এ ছাড়া লাইসেন্সবিহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। একই সঙ্গে হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল আরোহীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। 

ওসি বজলুর রশিদ বলেন, এসব উদ্যোগের সুফল পেতে শুরু করেছেন তাঁরা ধীরে ধীরে। চলতি ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে সাতটি। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। বেড়েছে হেলমেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। লোকজন যদি এভাবে নির্দেশনাগুলো মানেন এবং নিজেরা সচেতন থাকেন, তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও কমবে।

দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি সচেতনতার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে নিসচা (নিরাপদ সড়ক চাই) ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরাও। নিসচা গত ৯ মাসে সড়কে হেলমেট–সচেতনতা বাড়াতে ১৫টি কর্মসূচি পালন করেছে। পাশাপাশি ছয়টি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। নিসচার দিনাজপুর শাখার তথ্যমতে, জেলায় ২০১৮ সালে ৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৮৩ জনের। ২০১৯ সালে ১৩০টি দুর্ঘটনা ঘটে। মারা যান ১২৩ জন। ২০২০ সালে ৭৭টি দুর্ঘটনায় ৯৯ জন ও ২০২১ সালে ৭৮টি দুর্ঘটনায় ৮৬ জন মারা গেছেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬১টি। এসব দুর্ঘটনায় ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে শহরে বাড়ানো হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা। বর্তমানে শহরে ৩৫ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য যানজট ও দুর্ঘটনা এড়াতে কাজ করেছেন। বিভাগ জেলার অর্ধশত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গতিরোধক বসানোর কাজ করেছে।  

জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসলাম উদ্দিন বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনাজপুর ট্রাফিক পুলিশ পরিবহনবিষয়ক নানা অনিয়মের ঘটনায় ১৩ হাজার ৮৪৭টি মামলা করে। এ থেকে জরিমানা আদায় করা হয় ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এসব মামলার ৯৯ শতাংশ মোটরসাইকেল আরোহীকে হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিবন্ধনের বিষয়ে করা। এ ছাড়া দুর্ঘটনারোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে।