পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে ছাত্রীদের বিক্ষোভ

গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অপরাজিতা হলের একদল ছাত্রী ফটকের তালা ভেঙে বাইরে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন
ছবি: সংগৃহীত

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজিতা হলের ছাত্রীদের বিক্ষোভ হঠাৎ করেই হয়নি। এর পেছনে ছিল পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। সিট বাতিলের হুমকি ও কারণে-অকারণে হলে জারি করা বিভিন্ন নিয়মনীতিতে ‘মানসিকভাবে নির্যাতিত’ ছিলেন ছাত্রীরা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাতভর বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে।

ওই হলের শিক্ষার্থীরা বলেন, এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন হলের শিক্ষার্থীরা। সেই ক্ষোভে আগুন দেয় হলের রান্নার সরঞ্জাম ও ডিভাইস সরিয়ে ফেলার ঘোষণা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে হলের ছাত্রীদের ডেকে সাত দিনের মধ্যে রান্নার সরঞ্জাম, রাইস কুকার, আয়রনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন হল প্রাধ্যক্ষ রহিমা নুসরাত। এ সময় ছাত্রীরা তাঁকে রাইস কুকার রাখার অনুমতি দেওয়ার জন্য বারবার বোঝাতে থাকেন। কিন্তু সেসব কথা না শুনে চলে যান হল প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষরা। এটা ছাত্রীদের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন

তাঁরা বলেন, কারও কোনো কথা না শুনে হল প্রাধ্যক্ষ চলে যাওয়ায় ছাত্রীরা অপমানিত বোধ করেন। পরে ব্যাপারটি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে ৯টার দিকে হলের টিভিকক্ষে আলোচনায় বসেন ছাত্রীরা। এ সময় হলের প্রধান ফটকসহ সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় হল প্রশাসন। ব্যাপারটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ওই আলোচনা থেকেই হলের বাইরে গিয়ে বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত নেন ছাত্রীরা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত সাড়ে ১০টার দিকে হলের তালা ভেঙে বাইরে গিয়ে অবস্থান নেন তাঁরা। শুরু হয় বিক্ষোভ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালক এসে তাঁদের আশ্বস্ত করলেও তা মেনে নেননি ছাত্রীরা। পরে রাত ২টার দিকে হল প্রাধ্যক্ষ ছাত্রীদের ১০ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভ স্থগিত করে হলে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। ছাত্রীরা আসলে কোমলমতি, তাঁরা অনেক কিছুই বোঝেন না। এ কারণে তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
রহিমা নুসরাত, প্রাধ্যক্ষ, অপরাজিতা হল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথমে অপরাজিতা হল থেকে আন্দোলন শুরু হলেও পাশের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ছাত্রীরাও অংশ নেন তাতে। পরে ওই আন্দোলনে যুক্ত হন ছাত্ররাও। শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যাওয়ার পর সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শিক্ষার্থীরা যথারীতি ক্লাসে গেছেন।

বিক্ষোভরত ছাত্রীদের উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো হলে রাইস কুকার ও রান্নার সরঞ্জামাদি ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য প্রাধ্যক্ষকে ক্ষমা চাইতে হবে, হলে প্রয়োজনে অভিভাবক ও নারী আত্মীয়দের থাকার অনুমতি দিতে হবে, হলে পানি ও খাবারের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে, হল প্রাধ্যক্ষ তাঁর নিজ ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) ছাত্রীদের ডেকে ব্যক্তিগত ও একাডেমিক বিষয়ে হয়রানি করতে পারবেন না, হলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং হলের ছাত্রীদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।

ওই হলের অন্তত পাঁচজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এ সময় ছাত্রীরা জানান, হলে একটি ডাইনিং ও একটি ক্যানটিন রয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ১০ থেকে ১৫ দিন ডাইনিং বন্ধ থাকে। আর ক্যানটিনের খাবার মান খুব বেশি ভালো নয়। বাইরের খাবারের দামও অনেক বেশি। এসব কারণে ছাত্রীরা হলে শুধু রাইস কুকার ব্যবহার করতেন। এত দিন হল থেকে তা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ওই রাইস কুকারেই ভাত-তরকারি রান্না বা চা খাওয়ার পানিও গরম করা হয়। বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় গরম পানিও রাইস কুকারে করা হয়। এটি ছাত্রীদের জন্য খুবই দরকারি।

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই হলের এক ছাত্রী তরকারি কাটার বঁটি দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলে রান্নার সরঞ্জাম সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না রেখে হঠাৎ করে সেটি সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা ব্যাপারটি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না।

ওই ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, হলে ছাত্রীরা এমনভাবে থাকেন, যেন কারাগারে রয়েছেন। পান থেকে চুন খসলেই ডেকে নিয়ে বকাঝকা করা হয় এবং সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বা হল সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলেই ওই ছাত্রীকে ডেকে খারাপ আচরণ করে হল প্রশাসন। তাদের সামনেই ওই স্ট্যাটাস মুছে ফেলতে হয়। হলের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই খেপে যান প্রাধ্যক্ষরা। সেসব সমস্যা সমাধান না করে উল্টো ছাত্রীদের বকাঝকা করেন তাঁরা।

ছাত্রীরা আরও বলেন, রাত ৯টায় হলের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে কোনো ছাত্রী হলে প্রবেশ করতে না পারলে ব্যাপারটি তাঁদের অভিভাবক বা ডিসিপ্লিনের শিক্ষকদের জানানো হয়। এ সময় অভিভাবকদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণও করেন না প্রাধ্যক্ষরা। এর প্রভাব পড়ে ওই শিক্ষার্থীর ওপর। আধা ঘণ্টা দেরি করে হলে আসায় হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, এমন ঘটনাও রয়েছে। এমনকি হলে মা, বোন বা কোনো বান্ধবী বেড়াতে এলে তাঁদের রাখা যায় না। এসবের বাইরে কিছু হলেই হলের সিট বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। হল প্রাধ্যক্ষদের দেখাদেখি হলের অন্য স্টাফরাও ছাত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। হলে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সব সময় একধরনের মানসিক নির্যাতনের মধ্যে থাকেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।

তবে ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা বা সিট বাতিলের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অপরাজিতা হলের প্রাধ্যক্ষ ও অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক রহিমা নুসরাত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হলের মধ্যে একজন মেয়ে বঁটি দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রভোস্ট কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রীদের কক্ষ থেকে দা, বঁটি, ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রাইস কুকার সরিয়ে ফেলতে বলা হয়। যখন ছাত্রীদের ডেকে এগুলো বলা হয়, তখন কেউ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। পরে তাঁরা হল গেটের তালা ভেঙে বাইরে এসে বিক্ষোভ করেন। তিনি বলেন, ছাত্রীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। ছাত্রীরা আসলে কোমলমতি, তাঁরা অনেক কিছুই বোঝেন না। এ কারণে তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।