পরিত্যক্ত বিলে সবাই মিলে মাছ চাষে বাড়তি আয়

বিলের পানিতে ছাড়া হচ্ছে মাছের পোনা। গত বছর রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বিলসতি বিলে
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বাগমারার বিল এলাকাগুলো বর্ষা এলেই পানিতে থই থই করে। কয়েক বছর আগেও শাপলা-পদ্মসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ আর আগাছায় ভরে থাকত এসব খাল-বিল। যথাসময়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়াতে চাষাবাদে বিলম্ব হতো, তবে পরিস্থিতি এখন বদলেছে।

সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে এসব বিলে এখন মাছ চাষ করছেন স্থানীয় লোকজন। যার মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন বিলের জমির মালিক, স্থানীয় মৎস্যজীবী ও কৃষকেরা। মৎস্য বিভাগের হিসাবে, প্রতি বর্ষায় এসব বিল থেকে উৎপাদিত হচ্ছে অতিরিক্ত ১৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ।

মৎস্য বিভাগ, কৃষক ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাগমারায় ছোট-বড় মোট ৪১টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি সরকারি ও বেসরকারি বিল ৩০টি। জমির পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার বিঘা। বর্ষাকালে জমিগুলো পরিত্যক্ত হওয়ার পর সেখানে মাছচাষের জন্য স্থানীয়দের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। যাতে থাকেন বিলের জমির মালিক, কৃষক, মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীরা। তাঁরা সবাই মৌসুম শেষে লাভের ভাগ পান। ২০১৩ সাল থেকে সমন্বিত প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়, তবে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ২০১৬ সাল থেকে। বাগমারায় প্রতিবছর মোট ২৭ হাজার ৪৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শুধু বর্ষাকালে বিলে উৎপাদিত হয় অতিরিক্ত ১৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ।

মাঝের খাবার দিচ্ছেন প্রকল্পের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর বাগমারার কোলা বিলে
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলার নরদাশ ইউনিয়নের কোলা বিলে জমি আছে ১ হাজার ৩০০ বিঘা। বিলের আশপাশের মনোপাড়া, চণ্ডীপুর, চাইসাড়া এবং কোয়ালিপাড়া গ্রামের জমির মালিক, মৎস্যজীবী, মৎস্যচাষি ও কৃষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সাত-আট বছর ধরে সেখানে বর্ষাকালে মাছ চাষ হচ্ছে।

প্রকল্পটির সাধারণ সম্পাদক কোয়ালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন। বিলে তাঁর ব্যক্তিগত কয়েক বিঘা জমি রয়েছে। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে বিলের জমিতে কোনো চাষাবাদ না হওয়ায় সেখানে মাছ চাষ করেন তাঁরা। তাঁদের কমিটিতে ৪৩০ জন সদস্য আছেন। প্রত্যেকে মাছচাষের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে থাকেন।

কোলা বিলের প্রকল্পের সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, গত বছর প্রায় চার কোটি টাকার মাছ বিক্রি করা হয়েছে। খরচ বাদে আয় থেকে লাভের অংশ সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়।

উপজেলার দ্বীপপুর ইউনিয়নের লিখড়া বিলের ১ হাজার ৭০০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ বিঘাতে বোরো চাষাবাদ হয়ে থাকে। বোরো ধান কাটার পর জমিগুলো পরিত্যক্ত হয়। এরপর সেখানে মাছ চাষ হয়ে থাকে। চকহরি, নায়ান কুণ্ডু, খাঁপুর, লাউবাড়িয়া, নানসর ও হাসানপুর গ্রামের ৪০০ জন এই প্রকল্পে জড়িত।

বিলে চাষ করা মাছের লাভের অংশ পান জমির মালিক, মৎস্যজীবীসহ সব সদস্য। রাজশাহীর বাগমারা উজেলার কাদার বিলে
ছবি: প্রথম আলো

লিখড়া বিলে জমি রয়েছে দেউলা গ্রামের আবদুল জব্বার মণ্ডল, নুরুল ইসলাম, কোয়ালিপাড়া গ্রামের মোবারক হোসেন, চাইসাড়া গ্রামের আসাদুল ইসলাম, চণ্ডীপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম, পীরগঞ্জ গ্রামের দুলাল হোসেন, মোহনপুর গ্রামের আবদুল মান্নানের। তাঁরা বলেন, প্রকল্পের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি পাঁচ মাসের জন্য জমির ইজারা মূল্যও দেওয়া হয়। বিলের পরিত্যক্ত জমি থেকে টাকা, মাছ চাষের লাভের অংশ এবং বিনা মূল্যে সেচ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

এই প্রকল্পের মৎস্যজীবী সদস্য তপন কুমার হালদার, নিপেন্দ্র হালদার ও অসিম বলেন, তাঁরা সাধ্যমতো টাকা দিয়ে প্রকল্পের সদস্য হন। মৌসুম শেষে সন্তোষজনক লাভ পান। মাত্র পাঁচ মাসের লাভের টাকায় গোটা বছর সংসার চলে।

উপজেলার বাসুপাড়া ইউনিয়নের কাদার বিলের চারপাশে দেউলা, খুজিপুর ও মধুপুর গ্রাম। ২০১০ সাল থেকে বিলটিতে মাছ চাষ হয়ে আসছে। জমির মালিক, স্থানীয় বাসিন্দা মিলে ১০০ জন এই প্রকল্পের সদস্য। প্রকল্পের কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিলটিতে মাছ চাষের জন্য জমির মালিকদের বিনা মূল্যে সেচ সুবিধার পাশাপাশি বিঘাপ্রতি টাকা দেওয়া হয়। প্রতিবছর বিলের মৎস্য চাষ প্রকল্প থেকে প্রায় এক কোটি টাকা লাভ হয়ে থাকে।

এই বিলগুলোয় কিছুদিন আগেও বর্ষাকালে কোনো মাছ চাষ হতো না বলে জানান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন এসব বিলে মাছ চাষ করার কারণে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি মাছের চাহিদা পূরণে সহায়ক হচ্ছে। মৎস্য বিভাগ চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে থাকে। এর ফলে কম খরচে ভালো ফলন ও দাম পাওয়া যায়।