জামাইদের পদচারণে মুখর মাছের মেলা

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপাজেলার বিনিরাইল গ্রামে প্রতি বছর একদিনের জন্য বসে মাছের মেলা। এটি জামাই মেলা নামেও পরিচিত। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল গ্রামে ২৫০ বছর ধরে আয়োজন করা হচ্ছে এমন মাছের মেলা। মাছের মেলাটি এখন রূপ নিয়েছে ওই এলাকার ঐতিহ্যে। অনেকে আবার এই মেলাকে জামাই মেলা হিসেবে চিনে থাকেন। মেলায় কোন জামাই কত বড় মাছ কিনলেন, সেটি নিয়ে চলে একধরনের প্রতিযোগিতা। দুই শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বড় বড় বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন।

মাছের ক্রেতা কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর গ্রামের জামাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, মেলা উপলক্ষে প্রতিবছর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। মেলা থেকে বড় আকারের মাছ কেনার চেষ্টা করেন। এবার ৪০ কেজি ওজনের কাতলাসহ ৫৫ হাজার টাকার মাছ কেনা হয়েছে।

উপজেলা সদর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস। তিনি ২৫ বছর ধরে মাছের মেলায় মাছ বিক্রি করছেন। এবার তিনি ৫০ কেজি ওজনের একটি বাগাড় মাছ নিয়ে এসেছেন। মাছটির দাম চাইছেন ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে একজন মাছটির দাম বলছেন ৫০ হাজার টাকা। এ নিয়ে চলে বেশ দর–কষাকষি। মাছটির জন্য ক্রেতাদের চাইতে দেখতে আসা মানুষের ভিড় ছিল বেশি।

ঘোড়াশাল থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছেন মাছ ব্যবসায়ী সজীব চন্দ্র দাস। তাঁর কাছে ছিল ৪০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ। মাছটির জন্য ১ হাজার টাকা কেজি দরে ৪০ হাজার টাকা হেঁকেছেন। পরে তিনি মাছটি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

মূলত এটা জামাই মেলা হলেও সবার কাছে এর পরিচিতি মাছের মেলা হিসেবে। মেলা ঘিরে কয়েক জেলার মানুষের সমাগম হয় এখানে। আর দিনটির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিন এলাকার প্রতিটি বাড়িতে থাকে নতুন–পুরোনো অতিথি দিয়ে ভরা।

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপাজেলার বিনিরাইল গ্রামে প্রতি বছর একদিনের জন্য বসে মাছের মেলা। এটি জামাই মেলা নামেও পরিচিত। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ থেকে অনেক মানুষ এই মেলা উপলক্ষে কালীগঞ্জে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ছোট–বড় বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়ে জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয়।


সরেজমিনে দেখা যায়, চারদিকে ফসলের মাঠ। কেউ ধান রোপণ করছেন, কেউবা সবজি। মাঝের একটি ফাঁকা মাঠে বসেছে মাছের মেলা। সকালে নানা স্থান থেকে সেই মেলায় মানুষ ছুটে আসছে। এর আগে ট্রাক, পিকআপ ও রিকশায় মাছ ব্যবসায়ীরা বড় বড় মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন মেলায়। দুপুরের মধ্যে দূরদূরান্ত থেকে আসা মাছের ক্রেতাদের ভিড়ে কোথাও যেন থাকার জায়গা নেই। তার মধ্যে সমানতালে চলছে মাছের বেচাবিক্রি।

মেলার আয়োজকেরা জানান, এবারের মেলায় দুই শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মেলায় মাছ ছাড়াও আসবাব, খেলনা, মিষ্টি ইত্যাদির দোকান রয়েছে। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাগাড়, আইড়, বোয়াল, কালবাউশ, পাবদা, গুলশা, গলদা চিংড়ি, বাইম, ইলিশ, কাইকলা, রুপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে হরেক রকমের দেশি মাছ। কেউ মাছ কিনেছেন, কেউবা দেখছেন আর ছবি তুলছেন। মেলায় কোনো কোনো মাছের ওজন ২০ থেকে ৫০ কেজি।

ভৈরব থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী অজিত চন্দ্র দাস বলেন, ‘২৫-৩০ বছর এই মেলায় মাছ নিয়ে আসি। এতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তৈরি হয়েছে ভালো সম্পর্ক। অনেক ক্রেতার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে। আগে মানুষ বেশি মাছ কিনত আর স্থানীয় মানুষ বেশি থাকত, কিন্তু এখন বিভিন্ন জেলার মানুষ আসে, ছবি তুলে ও ভিডিও করে নিয়ে যায়।’

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার জামাই আলমগীর হোসেন বলেন, ‘মেলার কথা খালি শুনে এসেছি, এবার এই প্রথম মাছের মেলায় এসেছি। বোয়াল, কাতলাসহ প্রায় এক লাখ টাকার মাছ কিনেছি। এখন মাছগুলো নিয়ে রওনা হয়েছি।’

মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কিশোর আকন্দ বলেন, মেলাটির প্রচলন কত বছর আগে শুরু হয়েছে, এর সঠিক তথ্য কেউ বলতে পারে না। তবে গ্রামের মুরব্বিরা জানান, আড়াই শ বছর আগে এই মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে। এটি মাছের মেলা হলেও মানুষ এটাকে জামাই মেলা হিসেবে চেনে। মেলাটি পৌষসংক্রান্তিতে, অর্থাৎ মাঘ মাসের প্রথম দিনে বিনিরাইলের এই মাছের মেলার আয়োজন করা হয়।