শেরপুরের নালিতাবাড়ী
বন্য হাতির ভয়ে আধা পাকা ধান কেটে নিচ্ছেন কৃষক
হাতির দলটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ি জঙ্গলে অবস্থান করছে। প্রতি রাতে ধান খাওয়ার জন্য হাতির দল লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার অনেক বোরো খেতের ধান এখনো পাকেনি। অথচ কৃষকেরা এই আধা পাকা ধানই কেটে নিচ্ছেন। এর কারণ বন্য হাতির আক্রমণ। বন্য হাতির পাল থেকে ফসল রক্ষায় আধা পাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে দুই সপ্তাহ ধরে হাতির পালকে প্রতিরোধ করতে তাঁরা ফসল রক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
বন বিভাগ, কয়েকজন কিষান–কিষানি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও, বাতকুচি, বুরুঙ্গা, কালাপানি ও পানিহাটা গ্রামের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা প্রায় ৩০০ একর জমিতে দুই শতাধিক কৃষক বোরো ধান আবাদ করেছেন। ওই এলাকায় ধান পাকতে আরও এক–দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। কিন্তু উপজেলার বাতকুচির মৌচাক, ডালুকোনা ও পানিহাটা সীমান্তবর্তী পাহাড়ি জঙ্গলে দুই সপ্তাহ ধরে শতাধিক বন্য হাতির দল তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করছে। গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে পাহাড় থেকে নাকুগাঁও, বুরুঙ্গা, কালাপানি ও পানিহাটা এলাকায় হাতির পাল ধান খাওয়ার জন্য সমতলে নেমে আসে। এ সময় এলাকাবাসী মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতির দলকে প্রতিরোধ করেন। পরে হাতির পালটি আবার জঙ্গলে চলে যায়।
বুধবার বিকেলে নাকুগাঁও, বুরুঙ্গা, কালাপানি ও পানিহাটা সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাতির ভয়ে স্থানীয় কিষান-কিষানি তাঁদের খেতের আধা পাকা বোরো ধান কেটে নিয়ে আসছেন। কেউ মাথায় করে সেই ধান খেতের পাশের রাস্তায়, আবার কেউ সীমান্ত সড়কে নিয়ে ফেলছেন। আবার কেউ সেই ধান সড়কেই যন্ত্রের মাধ্যমে মাড়াই করে ধান স্তূপ করে রাখছেন।
কী করমু, আত্তির (হাতি) ডরে আধা পাহা ধান কাডুন লাগতাছে। এ ছাড়া তো কোনো উপায় নাই। দেরি করলে সবই আত্তির পেডে যাইব, আমগোর তহন না খাইয়া থাহুন লাগব।
জাহানারা বেগমের (৫৫) স্বামী আক্তার হোসেন ১৭ বছর আগে মারা গেছেন। ধারদেনা করে নাকুগাঁও সীমান্তের ৩০ শতক জমিতে তিনি বোরো ধানের চাষ করেছেন। ফলন ভালোই হয়েছে। ধান পাকতে আরও ১০-১২ দিন সময় লাগবে। কিন্তু তার আগেই বুধবার একমাত্র ছেলে এবং আরও দুই নারী শ্রমিককে নিয়ে আধা পাকা ধান কেটে নেন জাহানারা বেগম। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী করমু, আত্তির (হাতি) ডরে আধা পাহা ধান কাডুন লাগতাছে। এ ছাড়া তো কোনো উপায় নাই। দেরি করলে সবই আত্তির পেডে যাইব, আমগোর তহন না খাইয়া থাহুন লাগব।’
বুরুঙ্গা গ্রামের কৃষক মুক্তার আলী বলেন, ‘আমি ৬০ শতক জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি। ফসল পাকতে ও কাটতে আরও এক সপ্তাহ সময় দরকার। কিন্তু হাতির আক্রমণের ভয়ে নিরুপায় হয়ে আধা পাকা ফসল কাটতে বাধ্য হচ্ছি। এই ফসল পাহারা দিতে গিয়া এক কৃষকের মৃত্যু হইছে। ফসল নিয়ে এলাকার কৃষকেরা হাতির ভয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন।’
হাতি প্রতিরোধে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা কাজ করছেন। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে যাঁদের ফসল নষ্ট হয়েছে, তাঁদের বন বিভাগের কাছে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে।
কালাপানি গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কালাপানি পাহাড়ের ঢালে ৭০ শতক জমিতে ধান চাষ করছি, ফলনও ভালো অইছে। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে আত্তি অত্যাচার করে। সবাই রাত জাইগা খেত পাহারা দেই। তাই নিরুপায় অইয়া আধা পাহা ধান কাইটা ফালাইছি। অহন দুশ্চিন্তাটা কিছুডা কমছে। কিন্তু এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার।’
এ ব্যাপারে বন বিভাগের মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাতির দলটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ি জঙ্গলে অবস্থান করছে। প্রতি রাতে ধান খাওয়ার জন্য হাতির দল লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। তাই ফসল রক্ষায় স্থানীয় অনেক কৃষক তাঁদের খেত থেকে আধা পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। হাতি প্রতিরোধে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা কাজ করছেন। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে যাঁদের ফসল নষ্ট হয়েছে, তাঁদের বন বিভাগের কাছে ক্ষতিপূরণ পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে।