‘বাবারে আমারে ছাইড়া দে বইলা চিৎকার করছিল হাশেম’

চোর অপবাদ দিয়ে হাশেম আলীকে মারধর করেছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মারধরে তাঁর পা ভেঙে গেছে। শনিবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

‘বাবারে আমারে ছাইড়া দে বইলা চিৎকার করছিল হাশেম। চেয়ারম্যানের পায়ে ধইরা কইছিল, আমি একটু খারাপ হইলেও চোর না। চেয়ারম্যান আর চেয়ারম্যানের দুই পোলায় খালি তারে কইতে কয়, “স্বীকার কর তুই মোবাইল চোর।” হাশেম কয়, “না, আমি চোর না। রাস্তা দিয়া যাওয়ার সময় জানালা দিয়া উঁকি দিছিলাম।” হাশেমের বউও কয়, “আমার জামাই চোর না।” পরে বউরে গেটের বাইরে পাঠাইয়া হাশেমরে পাইপ দিয়া পিটাইতে থাকে তারা। চিৎকার করলেও মাইর থামায় নাই চেয়ারম্যান।’

ঢাকার ধামরাই উপজেলার বড় চন্দ্রাইল এলাকায় নির্যাতনের শিকার ঠিকাদার মো. হাশেম আলীকে (৩৯) মারধরের বর্ণনা এভাবেই দেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। গত মঙ্গলবার চোর অপবাদ দিয়ে তাঁকে মারধর করেন স্থানীয় কুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান ও তাঁর স্বজনেরা। ওই দিনের ঘটনায় এলাকাবাসী হতবাক হয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাশেমকে ভেতরে নিয়ে চেয়ারম্যান পা দিয়ে উঠানের পাকা জায়গায় ফেলে মুখ চাইপা ধরে। চেয়ারম্যানের পোলারা হাশেমকে রশি দিয়া পিছমোড়া করে বাঁধে। এরপর আরও কয়জন মিলা মারতে থাকে। পুলিশ আসলে হাশেমের ভাইয়েরা হাশেমকে হাসপাতালে নিয়া যায়।’

ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগ, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে চোর অপবাদে সমর্থকদের দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন চেয়ারম্যান। গুরুতর আহত অবস্থায় হাশেমকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মারধরে তাঁর পা ভেঙে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়েছে। আহত হাশেম কুল্লা ইউনিয়নের খাতরা গ্রামের বাসিন্দা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বাড়ির জায়গা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফরের সঙ্গে হাশেমদের বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিবাদেও জড়িয়েছেন। সম্প্রতি ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ি–সংলগ্ন স্থানীয় আবদুল বারেকের পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ করছিলেন হাশেম আলী। মঙ্গলবার রাতে বারেকের ছেলে হারিজুল ইসলাম কাজের জন্য হাশেমকে এক লাখ টাকা বিল দেন। ওই বিল নিয়ে হাশেম বাড়িতে ফিরছিলেন। পথে আনোয়ার হোসেন নামের একজনের বাড়িতে চুরির চেষ্টার অপবাদ দিয়ে চেয়ারম্যানের লোকজন তাঁকে আটক করেন। বিষয়টি শুনে হারিজুল ঘটনাস্থলে যান। তিনি হাশেমকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে আসেন। তখন হাশেমকে জোর করে বাসার ভেতরে নিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যান। কিছুক্ষণ পরে ভেতর থেকে ফটক আটকে দেওয়া হয়।

মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে ভাড়াটিয়া থাকেন। একটি কক্ষে চুরি করতে এসেছিল হাশেম। বিষয়টি টের পেয়ে বাড়ির লোকজন চোর বলে চিৎকার দিলে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিছু দূর গেলে লোকজন তাঁকে আটকে মারধর করে। পরে চেয়ারম্যান তাঁকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। এরপর কী হয়েছে জানি না। ওই কক্ষের ভাড়াটিয়া ইতিমধ্যে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন।’

হারিজুল ইসলাম বলেন, ওই দিন আনোয়ারের বাসার কাছে চোর ধরা পড়ার খবর শুনে সেখানে গিয়ে দেখেন, হাশেমকে মারধর করছেন আনোয়ারসহ কয়েকজন। তিনি তাঁদের বলেন, হাশেম কেন চুরি করবে? বিষয়টি ভালোভাবে জানতে হাশেমসহ অন্যদের নিয়ে তাঁর বাসার দিকে রওনা দেন। চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে এলে তাঁকে (হাশেম) আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। পরে বাড়ির ভেতর তাঁকে মারধর করা হয়।

আহত হাশেমের বড় ভাই জাহের আলী প্রথম আলোকে বলেন, মারধরে হাশেমের চিৎকারে এলাকাবাসী বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁদের জানান। পরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ কল করে পুলিশের সহযোগিতা চান। আধা ঘণ্টা পর পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে। তিনি বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) রাতে আমরা থানায় গিয়ে ওসিকে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কাল (রোববার) সকালে আমাদের যেতে বলেছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বাড়িতে চুরি করতে গেলে স্থানীয়রা তাঁকে ধাওয়া দিয়ে আটক করে মারধর করে। পরে চৌকিদার তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসে। ওসিকে বিষয়টি জানাই। পুলিশ এসে তাঁকে হেফাজতে নেয়। আমার বাসায় তাঁকে মারধরের অভিযোগটি সত্য নয়।’

ধামরাই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অসীম বিশ্বাস বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে ৯৯৯–এর মাধ্যমে জানতে পারি, চেয়ারম্যানের বাড়িতে চোর সন্দেহে একজনকে মারধর করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান দাবি করেন, এলাকাবাসী হাশেমকে চোর হিসেবে মারধর করেছে। পরে দ্রুত ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।’

ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সিরাজুল ইসলাম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, উভয় পক্ষকে কাল (রোববার) সকালে আসতে বলা হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য শুনে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।