দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন কামাল হোসেন

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে ১৯৭১ সালে পাকিস্তারি বাহিনীর নির্যাতনে নিহত ৬৯৭ জনের স্মরণে এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়
ছবি : প্রথম আলো

১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে ৬৯৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ইতিহাসের সেই ভয়াল ঘটনার সাক্ষী কামাল হোসেন। সেদিন তিনিও হারিয়েছেন পাঁচ স্বজনকে। নিজেও মর্টারের গোলার আঘাতে আহত হন। সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো চোখ ছলছল করে ওঠে তাঁর।

হাতিয়া ইউনিয়নের চারজন প্রবীণের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ছিল রমজান মাসের ২৩তম রাত। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ সাহ্‌রির খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন আবার কেউ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টারের গোলা আর বন্দুকের অবিরাম গুলিবর্ষণে কেঁপে ওঠে দাগারকুটিসহ আশপাশের গ্রামগুলো। পুরে ছাই হয় বাগুয়া অনন্তপুর, রামখানা, মণ্ডলের হাট, নয়াদাড়া, রেডক্রসপাড়া, নীলকণ্ঠ ও দাগারকুটি গ্রামের বাড়িঘর। নিহত মানুষের বেশিই ভাগ ছিল নারী ও শিশু। যারা আগুন থেকে রক্ষা পায়, তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে লাশগুলো আগুনে ফেলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। বর্বরোচিত সেই ঘটনায় প্রাণ হারায় নিরীহ ও নিরস্ত্র ৬৯৭ জন।

হাতিয়া গণহত্যার সময় আহত কামাল হোসেন সেই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানান, ভোররাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালাতে শুরু করে। বাড়িঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারছিল পালাচ্ছিল। তিনি তখন ২২ বছরের যুবক। বামনী নদীর পাড় দিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে পালাতে যাবেন, এমন সময় তাঁর সামনে এসে একটি মর্টারের গোলা পড়ে। তাঁর গলা, বুক, হাত ও পায়ে আঘাত লাগে। তিনি সেখানে অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁর বাবা বাবর উদ্দিন পরিবার নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। পরে অনেকের সঙ্গে তাঁকেও গুলি করা হয়। বাঁ হাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গ্রামবাসী তাঁকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও ফেরেননি চাচা আবদুল ওহাব ও জোবেদ আলী। ওই চাচারাসহ তাঁর পাঁচ স্বজন শহীদ হন।

কামাল হোসেন আরও বলেন, ওই দিনের ধ্বংসযজ্ঞে যাঁরা যান, তাঁদের সবাইকে গণকবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও হাতিয়া গণহত্যার শিকার লোকজন কেউ শহীদের মর্যাদা পাননি। তাঁরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদেরও এখনো বিচার হয়নি।

১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী। তিনি জানান, ১৩ নভেম্বর এলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয় না। ২০০৯ সালে পুরোনো অনন্তপুর বাজারের কাছে একটি শহীদ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে নেই শহীদদের নামের তালিকা। ১৩ নভেম্বর হাতিয়া গণহত্যা দিবস জাতীয়ভাবে পালনের দাবি জানান তিনি।