‘আমার সব শ্যাষ অইয়্যা গেল, চাইরপাশ ফাঁকা অইয়্যা গেল’

বেঁচে যাওয়া দুই বছরের ছেলে আরমানকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন রিয়াজ মোল্লা। আজ রোববার দুপুরে বরিশালের বাকেরগঞ্জের ঢালমারা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মূল সড়ক থেকে বাড়িতে ঢোকার পথেই ভেতরে কান্না-আহাজারির আওয়াজ ভেসে আসছিল। উঠানে লোকজনের ভিড়। উঠান অবধি পৌঁছানোর আগেই পাশাপাশি তিনটি কবর চোখে পড়ে। সেখানে লোকজনের ভিড়। কেউ জিয়ারত করছেন, কেউ ফিরছেন, কেউ কাঁদছেন। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মা ও তাঁর দুই শিশুসন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো গ্রামটি শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে। এ ঘটনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না কেউ।

গতকাল শনিবার বরিশালের বাকেরগঞ্জের নিয়ামতি ইউনিয়নের ঢালমারা গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের ছিঁড়ে যাওয়া তারে স্পৃষ্ট হয়ে মারা যান এই গ্রামের রিয়াজ মোল্লার স্ত্রী সনিয়া বেগম (৩০), তাঁদের মেয়ে রেজভী আক্তার (১২) ও ছেলে সালমান (৯)।

আহাজারি করতে করতে রিয়াজ বলছিলেন, ‘আমার সব শ্যাষ অইয়্যা গেল, চাইরপাশ ফাঁকা অইয়্যা গেল।’ বেঁচে যাওয়া দুই বছরের ছেলে আরমানকে বুকে চেপে রিয়াজ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘এতটুক বাচ্চা লইয়্যা এহন আমি কোমনে যামু, কী করমু।’

এভাবে মা ও দুই শিশুসন্তানের মৃত্যুকে কেউ মেনে নিতে পারছেন না। গ্রামের লোকজন, প্রতিবেশী, স্বজন—সবাই এ ঘটনায় পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ঢালমারা গ্রামটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় রোববার সকালে বরিশাল থেকে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে লাগে বেলা একটা। বরিশাল-বাকেরগঞ্জ-বেতাগী আঞ্চলিক সড়ক ধরে নিয়ামতি বন্দরে যাওয়ার পথে মহেশপুর এলাকায় নামতে হয়। সেখান থেকে ছোট খাল পার হয়ে এক কিলোমিটার মেঠো পথ পায়ে হেঁটে ঢালমারা গ্রাম।

রোববার দুপুরে রিয়াজ মোল্লার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, এ ঘটনায় পল্লী বিদ্যুতের ঢাকা ও বরিশাল কার্যালয় থেকে করা দুটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিষয়টি তদন্তের জন্য এসেছেন। গ্রামবাসী, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ সময় স্থানীয় লোকজন এ ঘটনায় পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় কর্মীদের অবহেলাকে দায়ী করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।

শনিবার দুপুরে ঘরের পেছনে লেবুগাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে আনার জন্য যায় সালমান। এ সময় ঘরের পেছনের গাছগাছালির ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া পল্লী বিদ্যুতের একটি সংযোগ লাইনের তার ছিঁড়ে কাঁধের ওপর পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় শিশু সালমান। চিৎকার শুনে সালমানকে রক্ষায় এগিয়ে যায় মা সাদিয়া ও বোন রেজভী। পরে প্রতিবেশীরা তাৎক্ষণিক পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে ফোন করলে পুরো এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে পড়ে ছিল সাদিয়া ও তাঁর দুই ছেলে-মেয়ের নিথর দেহ।

প্রতিবেশী ফাতেমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় লোকেরা লাইনে কোনো সমস্যা হলে দু-তিন দিন ফোন করলেও আসেন না। যাঁরা টাকা দিতে পারেন, তাঁদেরটা আগে মেরামত করে দেন। তাঁদের অনিয়মের শেষ নেই। এই অনিয়মের কারণেই আজ তিনটা প্রাণ অকালে চলে গেল।

রিয়াহ মোল্লা ঢাকার পোস্তগোলায় ইজিবাইক চালান। বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও বৃদ্ধ বাবা সুলতান মোল্লা থাকতেন। ঈদে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। যাওয়ার কয়েক দিন পরই পেলেন এমন দুঃসংবাদ।

শনিবার দুপুরে যখন এ ঘটনা ঘটে, তখন রিয়াজ রাস্তায় ইজিবাইক চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন করে কেউ তাঁকে দ্রুত বাড়িতে আসতে বলেন। তাঁর মেয়ে রেজভী অসুস্থ, সে কথা জানানো হয়েছিল তাঁকে। এর মধ্যে রিয়াজের বড় ভাই ইলিয়াস ও তাঁর বোন, বোনের জামাইও তাঁর কাছে আসেন। দ্রুত তাঁরা ঢাকা থেকে রওনা দেন।

হোসনে আরা বেগম নামের এক প্রতিবেশী নারী আক্ষেপ করে বলেন, ‘চোহের সামনে সব শ্যাষ অইয়্যা গেল। দেখলাম আগুন জ্বলে, হ্যারপর সব শ্যাষ।’

হোসনে আরা বেগম জানান, ঈদের পর এ এলাকায় কালবৈশাখীতে বিদ্যুতের অনেক লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যেনতেনভাবে সেই লাইন জোড়াতালি দেওয়া হয়েছিল। এ জন্যই সেই জোড়াতালি দেওয়া তার ছিঁড়ে পড়ে সালমানের গায়ে। আর এতেই মা, ছেলে, মেয়ের এমন মৃত্যু হয়েছে। লাইন নিয়ে অবহেলা না করলে এমন ঘটনা ঘটত না।

রিয়াজের বড় ভাই ইলিয়াস মোল্লার কথাও একই। তিনি জানান, পল্লী বিদ্যুতের লাইনের আশপাশের গাছের ডালপালা যাঁরা কাটেন, লাইন মেরামত করেন, তাঁরা অদক্ষ। দৈনিক শ্রমিক দিয়ে এসব কাজ করানো হয়। এ ছাড়া সার্ভিস তারও নিম্নমানের। সংযোগ লাইনগুলো বনবাদাড়, বাড়ির চালার ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া হয়েছে। খুঁটিগুলোও জরাজীর্ণ ও নড়বড়ে। এতেই প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। তিনজনের এই মৃত্যু তাঁদের অবহেলার ফলেই হয়েছে বলে অভিযোগ ইলিয়াসের।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ পেতে গ্রাহকদের নানা ভোগান্তি হয়। বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে হয়। লাইনে ত্রুটি হলেও অর্থ গুনতে হয়। টাকা ছাড়া পল্লী বিদ্যুতের লোকজন নড়েনও না।

তদন্ত কমিটির সদস্য পল্লী বিদ্যুতের ঢাকা কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) রিয়াদ হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত। এ জন্যই জরুরিভাবে ও গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ তার নিম্নমানের, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে রিয়াদ হাসান বলেন, ‘এটা অসম্ভব। ল্যাবে পরীক্ষা করেই নির্ধারিত ও মানসম্মত তার আমরা ব্যবহার করি। আর অর্থ নেওয়ার বিষয়ে কেউ তথ্য-প্রমাণ দিলে অবশ্যই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য আমাদের আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তারা বিষয়গুলো দেখভাল করে। এরই মধ্যে অনেকগুলো অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’