‘অনেক কষ্টে আছি, কইলেও কেউ বোঝে না’
তখন বেলা সাড়ে ১১টা। সূর্যের প্রচণ্ড তাপ। গাজীপুরের শিববাড়ি মোড়ের পাশেই চান্দনা সিনেমা হলের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন। তাঁরা কেউ সিনেমা দেখতে আসেননি। সবাই খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল বা আটা কিনতে সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঢাকা-গাজীপুর সড়কের পাশেই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা ওই সিনেমা হলের সামনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে নারী-পুরুষের ভিড় চোখে পড়ে। ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রির স্থান থেকে নারী ও পুরুষের আলাদা দুটি দীর্ঘ সারি ছিল। নারীদের সারিতে প্রায় আড়াই শ এবং পুরুষদের সারিতে দেড় শর বেশি মানুষ তুলনামূলক কম দামে পণ্য কেনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এসব নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে না এলে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। চাল, আটা না নিয়েই ফিরে যেতে হয়। এ কারণে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে এসে অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপরও অনেকেই সিরিয়াল পাননি। তাঁদের পরের দিন আসতে বলা হচ্ছে।
চান্দনা সিনেমা হলের সামনে থেকে প্রায়ই চাল-আটা কেনেন গাজীপুরের লক্ষ্মীপুরা এলাকার বাসিন্দা রঞ্জিত কুমার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চান্দনা-চৌরাস্তায় জুতা সেলাইয়ের কাম করি। আয়রোজগার আগের মতো নাই। এহান থাইক্যা চাইল কিনবার না পারলে খাওয়াও বন্ধ থাহে। হের লাইগা কষ্ট হইলেও অন্ধকার থাকতেই লাইনে এসে দাঁড়াই। অনেক কষ্টে আছি। কইলেও কেউ বোঝে না।’
রঞ্জিত সকাল সাড়ে ৬টার দিকে এসে সারিতে দাঁড়িয়েছেন, তারপরও তাঁর সিরিয়াল নম্বর হয়েছে ৪২। সিরিয়ালটি তাঁর হাতের মধ্যে কলম দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছে। রঞ্জিতের মতো আরও অনেক নারী-পুরুষ কাকডাকা ভোর থেকে চাল বা আটার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
গাজীপুর শহরের পাশেই বিলাশপুর এলাকার বাসিন্দা রানী আক্তার বলেন, সকাল ৭টায় লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সিরিয়ালের জন্য তাঁর হাতে একটি টোকেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে তিনি পাঁচ কেজি চাল কেনার সুযোগ পান। সঙ্গে দুই কেজি আটা চাইলে তাঁকে বলা হয়, আটা না হয় চাল, যেকোনো একটি নিতে হবে। তাই শুধু চাল নিয়েই চলে যাচ্ছেন। একটু কষ্ট হলেও কম দামে চাল নিতে পেরেছেন, এটাই বড় পাওনা।
লক্ষ্মীপুরা এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন সুলতানা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখানে যাঁরা চাল বিক্রি করেন, তাঁরা মানুষের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। অনেকের মুখ দেখে সিরিয়াল ছাড়াই চাল বিক্রি করে দেন। অথচ আমরা একটু দেরি করে এলে চাল থাকলেও দিতে চান না। আশপাশে দেখেন, সিরিয়াল ছাড়া কত লোক বসে আছেন। তাঁদের এখন চাল দিচ্ছে না। কিন্তু আমরা চলে গেলেই পরে তাঁদের ঠিকই চাল দিবে।’
সরেজমিন দেখা যায়, সিনেমা হলের সামনে একটি ঘরের মধ্যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। সেই ঘরে বসেই একজন ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর বা টিপসই নিচ্ছেন আর অন্য দুজন চাল মেপে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। ওই ঘরের সামনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যেভাবে পারছেন, ধাক্কাধাক্কি করে পণ্য নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
হতদরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করার জন্য চাল ও আটা খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) কর্মসূচি চালু করে সরকার। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন ওএমএসের পরিবেশকের বিক্রয়কেন্দ্রে ভিড় করছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় অনেককে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
গতকাল গাজীপুর শহরসহ কয়েকটি ডিলার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মধ্যবিত্তদের অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার কেউ ভিড় কমার আশায় পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আবার ভিড় দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
গাজীপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ ফাতেমা বেগম সকাল থেকে শিববাড়ি ওএমএস পরিবেশকের বিক্রয়কেন্দ্রে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী স্থানীয় একটি কারখানায় চাকরি করেন। সকালে তিনি কাজে গিয়েছেন আর আমি ছেলেকে স্কুলে দিয়ে চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে একটু দেরি হয়েছে। অনেক কষ্ট করে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ৫ কেজি চাল পেয়েছি।’
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর মহানগরে ৩৪টি, কালিয়াকৈর উপজেলায় ২০, শ্রীপুরে ২০, কাপাসিয়া উপজেলায় ২, কালীগঞ্জে ১২টি কেন্দ্রে প্রতিদিন ১৮৮ টন চাল ও ২৭ দশমিক ৫ টন আটা বিক্রি করা হয়। এবার প্রতি ডিলারকে দৈনিক দেড় মেট্রিক টন চাল ও এক টন আটা বিক্রির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ডিলাররা মাথাপিছু ৫ কেজি চাল এবং আড়াই কেজি আটা ভোক্তাদের কাছে মাসে দুইবার বিক্রি করবে। চাল প্রতি কেজি ৩০ টাকা এবং প্রতি কেজি আটা ১৮ টাকায় বিক্রয় করতে হবে।
গাজীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান মোল্লা জানান, ‘গাজীপুরে প্রতি মাসে ২২ কার্যদিবস ৯০ জন ডিলার জেলার ৯০টি স্থানে এসব চাল ও আটা বিক্রি করছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দীর্ঘ লাইন তৈরি হচ্ছে। জনভোগান্তি এড়াতে প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের একজন করে সুপারভাইজার উপস্থিত থেকে পণ্য বিক্রি করেন, যাতে অনিয়ম ও ভোগান্তি এড়ানো যায়।’