অনাবৃষ্টিতে খেত চৌচির

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে গড়ে ৪০০ টাকা খরচ হবে। সেই হিসাবে জেলায় এবার ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪১৩ কোটি টাকা।

আমনের জমিতে সেচ দিচ্ছেন নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া এলাকার এক কৃষক। গত বুধবার
ছবি: প্রথম আলো

শ্রাবণ মাস শেষ। তবে বৃষ্টির দেখা নেই। গরম ও অনাবৃষ্টিতে আমন ধানের খেত ফেটে চৌচির। মাঠে মাঠে গভীর-অগভীর নলকূপ চালু করে ফসল বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন নওগাঁর কৃষকেরা। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সেচ দিয়ে আমন ধানের খেত বাঁচাতে এ মৌসুমে অতিরিক্ত ব্যয় হবে প্রায় ৪১৩ কোটি টাকা।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, আগে এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে গড়ে ডিজেল খরচ পড়ত গড়ে ৩০০ টাকা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এখন এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে গড়ে ৪০০ টাকা খরচ পড়বে। খরার কবলে পড়া আমনের খেতে ইতিমধ্যে কমপক্ষে তিনবার সেচ দিতে হয়েছে। এই মৌসুম এভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত চললে কমপক্ষে আরও চারবার সেচ দিতে হতে হবে। সেই হিসাবে জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমির আমনের ফসল রক্ষায় এবার সেচের খরচ বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪১৩ কোটি টাকা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার ১১ উপজেলার কমবেশি সব এলাকাতেই এবার খরার কবলে পড়েছে আমন। এর মধ্যে নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা ও মহাদেবপুর উপজেলার অবস্থা বেশি খারাপ। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকেরা গভীর-অগভীর সেচযন্ত্র চালু করে আমনের চারা লাগিয়েছেন।

এই পাঁচ উপজেলায় এবার আবাদ পুরোপুরি সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে মহাদেবপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ধান চাষ হয়ে থাকে। অন্য ছয় উপজেলার অর্ধেকের মতো জমিতে বৃষ্টির পানিতে আমনের চারা লাগানো গেছে। বাকি জমিতে সেচ দিয়ে জমি চাষ করতে ও চারা লাগাতে হয়েছে। তবে ২০-২২ দিন ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের চারা বাঁচানোর জন্য সেচযন্ত্র চালু রাখতে হচ্ছে কৃষকদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, খরা মোকাবিলায় মাঠে মাঠে ৪ হাজার ৮৬৮টি গভীর নলকূপ, ৫৫ হাজার ৭৯টি অভীর নলকূপ ও ৩ হাজার ২২৭টি এলএলপি (লো লিফট পাম্প) সেচযন্ত্র চালু রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৩ হাজার ১৭৪টি সেচপাম্প চালু আছে। এর মধ্যে ৫৩ হাজার ২৪২টি ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র।

সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের পার-বোয়ালিয়া মাঠে শ্যালো মেশিন (ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র) দিয়ে জমিতে সেচ দিচ্ছিলেন জগৎসিংহপুর গ্রামের কৃষক বাবুল হোসেন। তিনি বলেন, এবার আমন ও ইরি (বোরো ধান) আবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

কারণ, বোরোতে যেমন সেচ দিয়ে ধান আবাদ করতে হয়, তেমনই আমনেও সেচ দিতে হচ্ছে। এবার আমন আবাদ করে তাঁদের মরণদশা। সেচ দিয়ে ধানগাছ বাঁচাতে হচ্ছে। ধানের চারা লাগিয়েছেন ২০-২২ দিন হলো। একেক খেতে এই সময়ে তিন থেকে চারবার করে সেচ দেওয়া লাগছে। তার মধ্যে ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। একেবারে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রের মালিক আবদুল কুদ্দুস বলেন, এক বিঘা জমি একবার সেচ দিতে গড়ে ৪০০ টাকা লাগছে। অথচ আগে ৩০০ টাকাও লাগত না। সাত-আটবার করে সেচ দেওয়া লাগলে এক বিঘা জমিতে। এবার সেচ বাবদ খরচ পড়বে প্রায় তিন হাজার টাকা।

এদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে সেচকাজও ব্যাহত হচ্ছে। নিয়ামতপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের রামপুরা গ্রামে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের অপারেটর মোসলেম শেখ বলেন, ‘দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টাই থাকতেছে না। কারেন্ট (বিদ্যুৎ) না থাকায় কৃষকেরা দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও জমিতে সেচ দিতে পারতেছে না। বাধ্য হয়ে খেতে পানি চাওয়া কৃষকদের সিরিয়াল করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে একজন কৃষকের সিরিয়াল আসতে পাঁচ-ছয় দিন করে সময় লেগে যাচ্ছে। তত দিনে ওই সব কৃষকের খেতের ধানের চারা প্রায় মরে যাওয়ার অবস্থা হয়।’

বদলগাছি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ উপকেন্দ্রের পর্যবেক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, ১ জুলাই থেকে গত শনিবার পর্যন্ত (১৩ আগস্ট) পর্যন্ত ৪৪ দিনে ২০৫ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অথচ গত বছর শুধু জুলাই মাসেই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৭৪ মিলিমিটার। গত বছরের তুলনায় এই বছর তিন ভাগের এক ভাগের কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মাওলা বলেন, মৌসুমজুড়েই এভাবে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে এবার কৃষকদের আমন আবাদে বাড়তি ২৮ শতাংশ বেশি খরচ পড়তে পারে। গত বছর এক বিঘা জমিতে আমন আবাদে কৃষকের খরচ পড়েছে ১৪ হাজার টাকা। এবার কৃষকের খরচ পড়তে পারে ১৮ হাজার টাকা; অর্থাৎ প্রতি বিঘা জমিতে আমন আবাদে বাড়তি ৪ হাজার টাকা খরচ পড়বে।