কয়রার যে গ্রামে ৫৫০ বছরেরও আগে বসতি গড়েন খানজাহান আলীর শিষ্য
খুলনা জেলা শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার সবুজ-শ্যামল ছবির মতো গ্রাম ‘আমাদী’। গ্রামটির মেঠো পথ, সারি সারি গাছপালা, ফসলের খেত, শানবাঁধানো পুকুরঘাট দেখলে মনে হয়, এ যেন শিল্পীর রংতুলি দিয়ে আঁকা কোনো ছবি। ৫৫০ বছরেরও আগে খানজাহান আলীর (রহ.) বিশ্বস্ত সহচর বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ ও তাঁর ছেলে ফতে খাঁ এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা জঙ্গল কেটে আবাদ শুরু করার পর সেখানে নতুন জনগোষ্ঠীর মানুষের আগমন হওয়ায় গ্রামের নাম ‘আমাদী’ হয়েছে বলে ইতিহাসবিদেরা তাঁদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ সালে বাংলার সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। ওই সময় হজরত খানজাহান আলী (রহ.) দক্ষিণবঙ্গে আসেন। তিনি যশোরের মুড়লী পর্যন্ত পৌঁছে কাফেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একদল সঙ্গী নিয়ে তিনি নিজে বাগেরহাটের দিকে রওনা দেন। আরেক দল খানজাহান আলীর বিশ্বস্ত সহচর বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ দিকে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার আমাদী এলাকায় এসে বসতি গড়েন।
আমাদী গ্রামে বুড়া খাঁর বসতি স্থাপনের ধারণা পাওয়া যায় সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন, বুড়া খাঁ খানজাহান আলীর প্রধান সহচর ছিলেন। আমাদী গ্রামের পশ্চিম দিকে নদীর কূলে বুড়া খাঁ ও ফতে খাঁ উভয়ের কবর ছিল। কবরের অনতিদূরে বসতবাড়ির ভগ্নাংশের নানা চিহ্ন আছে।
সাড়ে পাঁচ শ বছরেরও আগে বোরহান খাঁ যখন আমাদী এলাকায় এসেছিলেন, তখন ছিল সুলতানি যুগ। এর পরের সময়টা ছিল মোগল যুগ। সুলতানি আমলের সেই ইটগুলো এখনো আমাদী গ্রামে আছে।
‘কয়রা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইয়ে কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আ ব ম আবদুল মালেক লিখেছেন, ‘পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ ও তাঁর ছেলে ফতে খাঁ আমাদী এলাকায় আসেন। তাঁরা সেখানে মসজিদকুঁড় মসজিদটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে আমাদী ভূমি অফিসের দক্ষিণ পাশে তাদের বসতভিটার নিদর্শন আছে। এর পাশে কালের সাক্ষী হয়ে আছে তাঁদের খনন করা চাল ধোয়ার দীঘি, ডাল ধোয়ার দীঘি, হাতি বান্ধার দীঘিসহ নানা কিছু। আমাদী বাজারের পূর্ব পাশে আছে আমাদীর দীঘি।’
কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে আমাদী গ্রামের অবস্থান। বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁর বসতভিটার স্থানে গিয়ে দেখা যায়, বসতভিটা বলতে সেখানে কোনো ঘরবাড়ি নেই, আছে শুধু একটি উঁচু ঢিবি। তার ওপরে বড় বটগাছের ভেতর থেকে একটি খেজুরগাছ বেরিয়ে বটগাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডালপালাসহ ওপরের দিকে উঠেছে। খেজুরগাছের গোড়ার অংশ বটগাছের কাণ্ডের মধ্যে ঢাকা পড়েছে। ঢিবির আশপাশে প্রাচীন বসতির ইট–পাথরের খণ্ডগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
উঁচু ঢিবির ছবি তুলতে দেখে ফিরোজা বেগম নামের এক নারী এগিয়ে এসে বলেন, ‘পীরের বাড়ির ছবি তুলছেন নাকি?’ এরপর বলতে থাকলেন, পাশেই তাঁর বাড়ি। এখানে আগে বড় বড় গাছ ছিল। স্তূপ করা ছিল পুরোনো আমলের ছোট ছোট ইট। ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গাছগুলো সব ভেঙে পড়ে। পীর বুড়ো খাঁর ইবাদতখানা দরগা আর মাজার ছিল মূল সড়কের পাশে। কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে সেসব হারিয়ে গেছে।
বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁর বসত ভিটার সবচেয়ে কাছের বাড়ির বাসিন্দা শেখ তৌহিদুল ইসলাম এগিয়ে এসে জানান, তাদের পূর্বপুরুষেরা বোরহান খাঁর খাদেম ছিলেন। তাঁর সম্পদও দেখাশোনা করতেন। পরে বংশপরম্পরায় বসতভিটার জমি ও দিঘিগুলোর মালিক হন শেখ বংশের লোকেরা।
হাতের ইশারায় পাশের একটি পুকুর দেখিয়ে শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এটা বুড়া খাঁর খনন করা চাল ধোয়ার দীঘি। পাশের সড়ক ধরে একটু সামনে গেলেই পড়বে ডাল ধোয়ার দীঘি। কাগজের হিসাবে চাল ধোঁয়ার দীঘি তিন বিঘা জমির ওপর আর বুড়া খাঁর বসতভিটা সাড়ে তিন বিঘা জমিতে। নদের তীরে বুড়া খাঁর দরগা ছিল, মাজার ছিল, সব নদে চলে গেছে। এখন তাঁর পাশে বুড়া খাঁর নামে মসজিদ-মাদ্রাসা হয়েছে। কিছুটা দূরে বুড়া খাঁর নির্মাণ করা মসজিদকুঁড় মসজিদ এখনো আছে।
কথার সূত্র ধরে আমাদী গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের তীরে গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে নির্মাণ করা হয়েছে একটি দোতলা মসজিদ আর একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার গায়ে লেখা ‘হযরত পীর বোরহান উদ্দিন খাঁ হাফেজিয়া মাদ্রাসা’।
মাদ্রাসার সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা তাপস কুমার দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই পীরের দরগা আর মাজারকে সব ধর্মের মানুষ শ্রদ্ধা করতেন। নদে ভেঙে হারিয়ে যাওয়ার পরও এখানে একটি শীলা পাথরের থান আর বটগাছ ছিল। সেখানে হিন্দু–মুসলিম সবাই মানত করতেন। সেটিও নদের ভাঙনে চলে গেছে।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা বোরহান খাঁর খাদেম ছিলেন। সম্পদও দেখাশোনা করতেন। পরে বংশপরম্পরায় বসতভিটার জমি ও দিঘিগুলোর মালিক হন শেখ বংশের লোকেরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ষাটোর্ধ শেখ শহীদ আলী জানান, কপোতাক্ষ নদ থেকে বসতভিটার পাশ দিয়ে সুন্দরবনের কয়রা নদীতে যাওয়ার জন্য একটি খাল খনন করেছিলেন বোরহান খাঁ। ওই নদীর নাম ছিল খানকা খাল। তবে সেটি দখল করে মানুষ বাড়িঘর গড়ে তোলায় এখন আর অস্তিত্ব নেই। বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁর খনন করা দুটি দীঘিতে মানুষের চাল ধোয়া আর ডাল ধোয়ার জন্য পৃথক ঘাট ছিল। এ কারণে ওই দুটি দীঘির নামকরণ হয় চাল ধোয়া ও ডাল ধোয়া দীঘি। আর সবচেয়ে বড়ো দীঘিটা আমাদী বাজারের পাশে।
হাতিবান্ধা দীঘির সম্পর্কে জানতে চাইলে শেখ শহীদ আলী বললেন, ‘ওইটা দীঘি না, এখানকার একটা জায়গার নাম। আমরা পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি, বোরহান খাঁর অনেকগুলো হাতি ছিল। কপোতাক্ষ পাড়ের একটা জায়গায় হাতি বাঁধা থাকত, এ জন্য ওই জায়গার নাম হাতিবান্ধা। কপোতাক্ষ পাড়ে জায়গাটা এখনো আছে।’
সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ‘বুড়া খাঁর বাড়ির দুই দিকে নদী ও অপর দুই দিকে খনিত খালে পরিখার কার্য করিয়াছিল। এই খালকে এক্ষণে খানকা বলে। সম্ভবত বুড়া খাঁ কর্তৃক কোনো পুষ্করিণী খনিত হয় নাই। দীঘি সম্ভবত পাঠান আমলের।’
কপোতাক্ষ পাড়ের সড়ক ধরে আমাদী বাজারের পাশে গিয়ে দেখা যায়, ২৪ বিঘা আয়তনের বিশাল দীঘি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় এলাকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস ছিল পীর বুড়া খাঁর খনন করা এই দীঘি। আশপাশের মানুষ দীঘির পানি মাটির কলসিতে ভরে হাটে হাটে বিক্রি করতেন। দীঘি দেখতে ও পানি পান করতে প্রতিদিন বহু দূরের মানুষ এসে ভিড় করতেন পাড়ে। এখন বুড়া খাঁর খাদেমের বংশধর শেখ পাড়ার লোকজন এখানে মাছ চাষ করেন।
আমাদী গ্রামের পাশের গ্রামটির নাম মসজিদকুঁড়। গ্রামের কপোতাক্ষ নদের তীরে ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁর নির্মিত মসজিদকুঁড় মসজিদ। দেড় হাজার বর্গফুট আয়তনের মসজিদের ভেতর মাত্র চারটি পাথরের খুঁটির ওপর ৯টি সুদৃশ্য গম্বুজ। দূরদূরান্ত থেকে চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর মসজিদটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
আমরা পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি, বোরহান খাঁর অনেকগুলো হাতি ছিল। কপোতাক্ষ পাড়ের একটা জায়গায় হাতি বাঁধা থাকত, এ জন্য ওই জায়গার নাম হাতিবান্ধা। কপোতাক্ষ পাড়ে জায়গাটা এখনো আছে।
সম্প্রতি আমাদী গ্রামে এসে বোরহান খাঁর বসতভিটার জায়গা পরিদর্শন করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইদ্রিস আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে পাঁচ শ বছরেরও আগে বোরহান খাঁ যখন আমাদী এলাকায় এসেছিলেন, তখন ছিল সুলতানি যুগ। এর পরের সময়টা ছিল মোগল যুগ। সুলতানি আমলের সেই ইটগুলো এখনো আমাদী গ্রামে আছে।
তবে প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগ না থাকায় আক্ষেপ করে ইদ্রিস আলী বলেন, এত বড় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বিষয়টির গুরুত্ব বোঝেন না। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাঁদের তেমন তাগিদও নেই। আমাদী এলাকার দীঘিগুলো ও বোরহান খাঁর বসতভিটার নিদর্শন সংরক্ষণ করা জরুরি।