সাতক্ষীরায় প্রতিদিন ৬ হাজার মানুষকে ইফতার করায় আহ্‌ছানিয়া মিশন

নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের আয়োজনে প্রতিদিন ইফতার করেন কয়েক হাজার মানুষ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রতিষ্ঠানটির মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র রমজান মাসজুড়ে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা কেন্দ্রীয় আহ্‌ছানিয়া মিশন বিরাট পরিসরে ইফতারের আয়োজন করে। বছরের পর বছর ধরে রমজানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন প্রতিষ্ঠানটির বিশাল মাঠে। এবারও প্রতিদিন ছয় হাজার মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ মিশনের মুখ্য হিসাবরক্ষক এবাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শেডের নিচে ৪ হাজার ৮০০ জনের বসার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জনের ইফতারি আশপাশের বাড়িতে পাঠানো হয়। ইফতারিতে ডিম, ছোলা, চিড়া, ফিরনি, কলা, শিঙাড়া, খেজুর দেওয়া হয়। এতে প্রতিদিন ব্যয় হয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মিশনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা ইফতারিসংক্রান্ত যাবতীয় খরচের টাকা জোগান দেন।

মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নলতা আহ্ছানিয়া মিশন বিশ্রামাগার চত্বরের পেছনে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। ৩২ জন মিলে কাজ করছেন। এ সময় সেখানে কাজ করতে থাকা কয়েকজন বলেন, ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয়েছে ইফতারি তৈরির আয়োজন। তাঁদের কেউ ছোলা রান্নার কাজে সহায়তা করছেন, কেউবা ফিরনি রান্না করছেন, কেউ আবার শিঙাড়া, ডিমসেদ্ধ ও চিড়া ভেজানোর কাজে ব্যস্ত। অনেকে কলা ও খেজুর পরিষ্কার ও বাছাই করছেন। প্লেট পরিষ্কারে ব্যস্ত একদল মানুষ। কেউ বোতলে পানি ভরছেন।

এভাবে প্রতিদিন বেলা দুইটা পর্যন্ত ইফতারি তৈরির কাজ চলে। এরপর শুরু হয় ইফতারের স্থান প্রস্তুত করার কাজ। এ ইফতারি প্রস্তুতের প্রধান বাবুর্চি নলতা গ্রামের মো. মহব্বত আলী প্রথম আলোক বলেন, রোজার এক মাস প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর থেকে তাঁরা কাজ শুরু করেন। ১২ জনের দল ১৫ মণ দুধের ফিরনি তৈরি, ২০০ কেজি ছোলা ভুনা, ৬ হাজার ডিম সেদ্ধ, চিড়া ভিজানোসহ ইফতারি প্রস্তুতের অন্যান্য কাজ করেন।

বয়স ৬২ ছুঁই ছুঁই মহব্বত আলীর। ৩৫ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এখানে ইফতারি তৈরির কাজ করছেন। তবে তাঁর ১২ জনের দলের অন্যদের সম্মানী দেওয়া হয়।

শিঙাড়া তৈরি করেন অপর একটি দল। ২০ জনের এ দলের প্রধান নলতা মোবারকপুর গ্রামের মো. মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ দলের ছয়জন নারী আলু কেটে প্রস্তুত করে দেন। অন্য ১৪ জন ময়দা মাখা থেকে শুরু করে শিঙাড়া তৈরি ও গণনার কাজ করেন।

চলছিল ইফতারের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকে নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

বেলা আড়াইটার দিকে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বিশাল মাঠে শামিয়ানা টাঙানো। স্বেচ্ছাসেবক মো. আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে ইঞ্জিনচালিত তিনটি ভ্যানে করে প্লেট ও পানিভর্তি বোতল নিয়ে আসা হচ্ছে মাঠে। বেলা তিনটার দিকে শামিয়ানার নিচে বসার জায়গা প্রস্তুত ও সাড়ে তিনটার দিক থেকে ইফতারি বণ্টন শুরু হয়।

স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান মো. আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন মাঠ প্রস্তুত, বসার ব্যবস্থা ও ইফতারি সরবরাহ জন্য চারটি দলে ২০০ জনের স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেন। সবাই এসেছেন নিজ উদ্যোগে।

স্বেচ্ছাসেবকদের একজন আবেদুর রহমান কাজের ফাঁকে বলেন, ‘এখানে দূরদূরান্ত থেকে রোজাদারেরা ইফতার করতে আসেন। তাঁদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, আমরা সেই চেষ্টা করি।’

অপেক্ষমাণ রোজাদারেরা আসতে শুরু করেন বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর থেকে। ছয়টা বাজতে না বাজতেই বিশাল শামিয়ানার নিচ পূর্ণ হয়ে যায়। কাতারে কাতারে বসা রোজাদারদের সামনে স্বেচ্ছাসেবকেরা পৌঁছে দিতে থাকেন ইফতারি।

ইফতারের সময় যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, তা তদারক করে মিশনের ১৫ সদস্যের কার্যকরী পর্ষদ। এর আহ্বায়ক সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদ সদস্য আ ফ ম রুহুল হক ও সদস্যসচিব চিকিৎসক নজরুল ইসলাম।

সাতক্ষীরা থেকে ইফতারে অংশ নিতে এসেছিলেন ১২ জন। তাঁদের একজন শহিদুল ইসলাম বলেন, ১২ বছর ধরে রমজান মাসে এখানে এক থেকে দুই দিন ইফতার করতে আসেন। অনেক মানুষ মিলে ইফতার করায় আনন্দ আছে। তা ছাড়া এখানে একটা অন্য রকম পরিবেশ থাকে।

রোজার দেড় মাস আগ থেকে তাঁদের প্রস্তুতি শুরু হয় বলে জানান নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের মুখ্য হিসাবরক্ষক এবাদুল হক। তিনি বলেন, ঝড় ও বৃষ্টিতে রোজাদারদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে চলতি বছর অস্থায়ী শেড নির্মাণ করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির আগে প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসের প্রতিদিন ১০ হাজার রোজাদারের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হতো। তখন আশপাশের মসজিদসহ সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোরের কয়েকটি মসজিদে প্রতিদিন পৌঁছে দেওয়া হতো ইফতারি।

নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের আহ্বায়ক আ ফ ম রুহুল হক বলেন, ১৯৩৫ সালে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকে তিনি প্রতিবছরই রমজানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। প্রথম অবস্থায় ৮-১০ জনকে ইফতারি খাওয়াতেন তিনি। পরে বাড়তে বাড়তে ১০ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হতো। মিশন কর্তৃপক্ষ খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর এ আয়োজনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।