নারী ভলিবলে রাজশাহীর ৫ কন্যা

জাতীয় নারী ভলিবল দলে রাজশাহীর ৫ কন্যা। বাঁ থেকে আজমিরা, আশা, সম্পা, টুম্পা ও দিতি
ছবি: সংগৃহীত

টুম্পা ও সম্পা দুই বোন। জাতীয় নারী ভলিবল দলের পরিচিত মুখ। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। খেলার পাশাপাশি চলছে তাঁদের পড়াশোনা। ২০১৬ সালে রাজশাহীতে নারী ভলিবলের প্রতিভা অন্বেষণে তাঁদের মনোনীত করা হয়। তাঁদের মতো রাজশাহীর পাঁচ কন্যা এখন জাতীয় দলে খেলছেন। তাঁদের একজন সম্প্রতি বার্লিনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ডস গেমে অংশ নিয়ে দলগতভাবে স্বর্ণপদক জিতেছেন।

জাতীয় দলে খেলা রাজশাহীর অন্য তিন খেলোয়াড় হলেন আজমিরা খাতুন (২০), দিতি রানী (২৭) ও আশা খাতুন (২৬)। তাঁদের মধ্যে ভলিবলের কল্যাণে একজন সংসারের হাল ধরেছেন।

রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোচ খন্দকার মমিনুর রশিদ বলেন, এই মেয়েদের কারণে রাজশাহী জাতীয় পর্যায়ে একের পর এক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। ১৯ জুলাই জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে এ জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই খেলোয়াড়েরা পুলিশ ও আনসার বাহিনীর পক্ষে চুক্তিতে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এবার ১২ জনের জাতীয় দলে রাজশাহীরই ৫ জন সুযোগ পেয়েছেন। সম্প্রতি রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ স্টেডিয়ামে তাঁদের অনুশীলন করতে দেখা যায়।

টুম্পা আক্তার ও সম্পা আক্তারের বাড়ি রাজশাহী নগরের কেদুরমোড় এলাকায়। তাঁদের বাবা আলাল চৌধুরী একজন সবজি ব্যবসায়ী। টুম্পার বয়স এখন ২১। এবার তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। আশা করছেন, খেলোয়াড় কোটায় স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাবেন। ছোট বোন সম্পা (১৯) এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ভাই বড়। তিনি বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ছোট বোনটি দশম শ্রেণিতে পড়ে।

বোনদের খেলার ব্যাপারে ভাই আরিফ চৌধুরী বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করলে বাড়তি যোগ্যতা তৈরি হবে ভেবে বোনদের খেলাধুলায় উৎসাহ দেন। তাঁরা ভালো করছেন দেখে পরিবারের সবাই খুশি।

টুম্পা ও সম্পা জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে মে মাসে নেপালে অনুষ্ঠিত ‘কাভা উইমেন ভলিবল চ্যালেঞ্জ কাপ-২০২৩’ খেলেছেন। এ ছাড়া তাঁরা দুই বোন বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে দুবার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ গেমস ও বিজয় দিবস টুর্নামেন্ট খেলেছেন। এ ছাড়া তাঁরা রাজশাহী মহিলা ক্রীড়া সংস্থার খেলোয়াড় হিসেবে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলছেন। টুম্পা বলেন, ভলিবল খেলছেন বলেই খেলোয়াড় কোটায় স্পোর্টস সায়েন্সে ভর্তির সুযোগটা পাচ্ছেন।

জাতীয় নারী ভলিবল দলের পরিচিত মুখ দুই বোন সম্পা ও টুম্পা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর আরেক কন্যা আজমিরা খাতুন স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল খেলতেন। এখন ভলিবলের জাতীয় দলের খেলোয়াড়। তাঁর ভাষ্য, ‘ভলিবলের সঙ্গে আছি বলেই ছোট থেকেই নিজের আয়ে পড়তে পারছি। না খেললে বাড়ি থেকে নিতে হতো। আমি মনে করি, ভলিবল আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’

আজমিরার বাড়ি নগরের বহরমপুর এলাকায়। বাবা আজহার আলী সৌদিপ্রবাসী। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ভাই বড়। টুম্পা ও সম্পার মতো আজমিরাও ২০১৯ সালে জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। চলতি বছরের জুনে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ডস গেমে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন আজমিরা। সেখানে ১৭০টি দেশ অংশ নেয়। বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। খেলায় বাংলাদেশ দল সার্বিয়াকে হারিয়ে সোনা জিতেছে। আজমিরা এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। সামনে মৌখিক পরীক্ষা আছে।

দিতি রানী স্কুলে পড়ার সময় থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলেন। আন্তস্কুল টুর্নামেন্ট খেলে তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। ভলিবলের প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে ২০০৯ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পান। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলার পাশাপাশি ইতিমধ্যে দিতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘খেলার মধ্যে আছি বলেই পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছি। তা ছাড়া আরও আগে আমার বিয়ে হয়ে যেত। পড়াশোনা শেষ করা হতো না।’

রাজশাহীর পাঁচ খেলোয়াড়ের মধ্যে দিতিই প্রথম জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। তাঁর বাড়ি নগরের রানীনগর এলাকায়। বাবা গৌর সরকার তবলা প্রশিক্ষক। দিতি রানী বলেন, তাঁর বাবার খেলাধুলার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর পক্ষে ভলিবল টুর্নামেন্ট খেলেছেন। তিনি পরিবারেও কিছুটা সহযোগিতা করতে পারেন। এখন খেলার পাশাপাশি চাকরির পড়াশোনা করছেন।

সম্পা ও টুম্পা দুই বোন
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর আরেক কন্যা আশা খাতুন ছোটবেলায় বাড়ির পাশে রাজশাহী কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলতেন। খেলা দেখে জাতীয় দলের একজন হ্যান্ডবল খেলোয়াড় একদিন এসে বলেন, ‘তোমার হাইটটা ভালো। তুমি কি ভলিবল খেলবে?’ আশা বলেন, ‘আমি রাজি হয়ে গেলাম। সেই থেকে শুরু। ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলছি।’

আশা খাতুনের বাড়ি নগরের দরগাপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবা সৈয়দ আলী মারা গেছেন। ছয় বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আশা অষ্টম। পারিবারিক সমস্যার কারণে এসএসসির পরে আর পড়তে পারেননি। তিনি এখন দুই ভাই ও মায়ের সংসারে আছেন। ভাইদের সঙ্গে তাঁকেও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।