মেহেদী বলেছিল, ‘আব্বা আমি শনিবার বাড়িতে আসব’

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে ছেলে মেহেদী হাসানের নিহতের খবরে অচেতন মা। নির্বাক স্বজনেরা। শুক্রবার দুপুরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার দেওড়া গ্রামেছবি : প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামের বাসিন্দা মেহেদী হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বাবাকে মুঠোফোনে জানিয়েছিলেন, আগামীকাল শনিবার তিনি বাড়ি আসবেন। এক দিন আগেই বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু নিথর দেহে, অন্যের কাঁধে ভর করে। গতকাল রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান মেহেদী। আজ শুক্রবার তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। তাঁর মৃত্যুর খবরে গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

দুপুরে মেহেদীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের মেঝেতে তাঁর মা কল্পনা বেগম সন্তান হারানোর বেদনায় বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। পাশে মেহেদীর ভাই ইস্রাফিল মিয়া বসে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শোকে পাথর বোন সুমাইয়া আক্তার ও বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে আয়নাল। বাড়িতে পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়।

আরও পড়ুন

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া বহুতল ভবনটির নিচতলায় ‘আপেল অ্যান্ড জুস বার’ নামে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে চাকরি করতেন মেহেদী ও তাঁর ছোট ভাই ইস্রাফিল। প্রায় ১০ মাস আগে সেখানে চাকরি নেন ইস্রাফিল। একই প্রতিষ্ঠানে তিন মাস আগে কাজ শুরু করেন মেহেদী। তিনি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু সংসার বেশি দিন টিকেনি। এইচএসসি পাসের পর দীর্ঘদিন ধরে বেকার ছিলেন। এ জন্য ইস্রাফিল তাঁর ভাইকে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজের সুযোগ করে দেন।

আরও পড়ুন

মেহেদীর বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তাঁর ৩১ শতাংশ ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়ির পাশে থাকা একটি সেচযন্ত্র দেখাশোনা করে আয় করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল তাঁদের সংসারে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।

মোয়াজ্জেম বলেন, ‘গতকাল দুপুরে মেহেদী ফোন দিছে, “আব্বা আমি শনিবার বাড়িতে আসব”। মেয়ের জামাইরে ফোন দিয়ে বলেছে, “ভাই আপনি বাড়ি যান আমি আসতেছি”। এর মধ্যে রাত ১০টার দিকে ফোন আইছে। ওর মা দৌড়াইয়া কইতাছে মেহেদী আর ইস্রাফিল গো রেস্টুরেন্টে আগুন ধরছে। ওরা ফোন ধরে না। কতক্ষণ পরে ইস্রাফিল আমারে ফোন দিছে, “আব্বা আমাগো এনে আগুন ধরছে। আমি সাততলায় উঠছি। ভাইরে পাইতাছি না”। মেহেদী বাড়ি আসার কথা রাখল না।’

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেহেদী ও ইস্রাফিল একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মাসে ২৪ হাজার টাকা পেতেন। সেখান থেকে ৮–১০ হাজার টাকা তাঁরা বাবাকে পাঠাতেন। ওই টাকাসহ নিজে যা আয় করতেন, তাই দিয়ে সংসার চালাতেন মোয়াজ্জেম।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইস্রাফিল জানান, যখন আগুন ধরছিল, তখন পুরো ভবনটিতে ক্রেতায় ভরা ছিল। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো ভবন। কেউ বলছিলেন ওপরে যাও, কেউ বলছিলেন ওপরে যাওয়া যাবে না।

ইস্রাফিল বলেন, ‘আমি ভাইরে নিয়া অর্ধেক পর্যন্ত সিঁড়িতে উঠছি। তখন কেউ বলেছিল নিচে নেমে যেতে। তখন ভাই আমাকে বলে, “তুমি দাঁড়াও, আমি দেখি নিচে নামা যায় নাকি”। ও নিচে নামে, আমি ঠেলাঠেলি কইর‌্যা ওপরের দিকে উঠি। ওইঠা ছাদে গেছি, দেখি ফাঁকা আছে। ফোন দিয়া জানলাম ভাই দুইতলায় কাচ্চি ভাইয়ে ঢুকছে। ও আর ব্যারিয়া পারে নাই। ওপরেও গেট আটকিয়ে দিছিল।’

দেওড়া গ্রামের বাসিন্দা উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির পরিচালক এ কে এম আল সরোয়ার টিপু জানান, ঘটনাটি দেওড়া গ্রামবাসীর জন্য খুবই মর্মান্তিক। গ্রামের ছেলেটা যে মারা গেছে, তাঁর ছোট ভাই তেমন কর্মক্ষম নয়। তাঁদের বাবা বেকার। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করা প্রয়োজন।

বানাইল ইউনিয়ন কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজম খান বলেন, মেহেদী খুব ভালো ছিলেন। সবার সঙ্গে উঠা–বসা করতেন। কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত ছিলেন না। গ্রামবাসী সবাই খুবই মর্মাহত।