নার্সারিতে কাজ করা আলিফ নিজেই নার্সারির মালিক 

নিজের নার্সারিতে আলিফ নূর। ৯ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আকবরপুরে
ছবি: প্রথম আলো

আলিফ নূর ওরফে আরিফ (৩৫) একসময় অন্যের নার্সারিতে চাকরি করেছেন। সবজি চাষ শিখতে নানা স্থানে ঘুরে বেরিয়েছেন। এখন তিনি নিজেই একজন সবজিচাষি, একটা নার্সারির মালিক। তাঁর নার্সারিতে এখন কাজ করছেন ২০-২৫ জন। নিজের গড়ে তোলা আরিফ অ্যাগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নার্সারি এখন শুধু আলিফের রুটিরুজির বিষয় নয়, তাঁর গৌরবও।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আকবরপুরে গড়ে উঠেছে আরিফ অ্যাগ্রো। ৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে নার্সারিতে গিয়ে দেখা গেছে, নার্সারিতে ঢোকার মুখেই একটি পিকআপ ভ্যানে টমেটোর চারাভর্তি ক্যারেট তোলা হচ্ছে। কয়েকজন শ্রমিক গাড়িতে ক্যারেট তুলে দিচ্ছেন। নার্সারির ভেতরে সারি সারি অনেকগুলো পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি শেড। শেডের ভেতর কোনোটিতে টমেটোর চারা আছে, কোনোটি খালি। খালিগুলোর চারা বিক্রি হয়ে গেছে। আরও কিছুদিনের মধ্যে এই শেডের জায়গায় মৌসুমি সবজি চাষ শুরু হবে। শ্রমিকেরা নার্সারির বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন।

হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে আসা আবদুল কাদির বলেন, ‘আমি টমেটোর চারা নিতে এসেছি। সাত হাজার চারা নিচ্ছি। প্রায় সাত-আট বছর থেকে আরিফ ভাইয়ের কাছ থেকে চারা নিই।’

আলিফ নূর বলেন, ২০০৮ সালের দিকে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল সড়কের পাশে, গিয়াসনগর বাজার-সংলগ্ন আকবরপুরে প্রায় পাঁচ কিয়ার (বিঘা) জমি ভাড়া নিয়ে তিনি তাঁর সবজি চাষ শুরু করেছিলেন। বছরে জমির ভাড়া প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শুরুতে তাঁর হাতে নিজের তেমন পুঁজি ছিল না। ধার-দেনা করে প্রায় লাখ টাকার মতো জোগাড় করে তা বিনিয়োগ করেছিলেন। এরপর চাষ করেছেন শসা, টমেটো, শাম্মাম, হলুদ তরমুজ ইত্যাদি।

আলিফ বলেন, মৌলভীবাজারে চাষবাস করলেও তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। আকবরপুরে সবজি চাষের আগে তিনি বিভিন্ন নার্সারিতে চাকরি করেছেন। সবজি চাষাবাদ বিষয়ে ধারণা নিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন। টমেটো চারার গ্রাফটিংয়ের পদ্ধতিটা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের টমেটো চাষিদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন। এখন গ্রীষ্মকালীন এবং আগাম টমেটোর গ্রাফটিং চারা তৈরি করেন তিনি। তিতবেগুন বা বনবেগুনের গাছের সঙ্গে গ্রাফটিং করে টমেটোর চারা উৎপাদন করা হয়। একটি চারা উৎপাদনে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ লাখ চারা উৎপাদন করেন। 

টমেটোর চারার ক্রেতারা আসেন হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, মাধবপুর, চুনারুঘাট, সুনামগঞ্জ, বিয়ানীবাজারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে। এ বছরও বারি-৮, মঙ্গল রাজা ও কনক জাতের প্রায় পাঁচ লাখ চারা উৎপাদন করেছেন তিনি। এই চারা বিক্রিও প্রায় শেষের দিকে। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। তাঁর নার্সারিতে এখন স্থায়ী ছয়জন শ্রমিক আছেন। আর অস্থায়ী ভিত্তিতে আরও ১৫ থেকে ২০ শ্রমিক কাজ করেন। একজন শ্রমিকের বেতন ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

আলিফ নূর বলেন, বছরে অনেক টাকার চারা ও সবজি বিক্রি করলেও খরচ-টরচ দিয়ে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। শেড তৈরির জন্য মাটি, পলিথিন ও বাঁশের দাম অনেক বেড়ে গেছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় চারার দাম বাড়েনি। ১০-১২ বছর আগেও যে দামে চারা বিক্রি করেছেন, এখনো সেই দামেই চারা বিক্রি হচ্ছে। তবে বর্তমানে তাঁর আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না। নিজের টাকায় টমেটোর বীজ কিনতে পারেন। বিভিন্ন জাতের এক কেজি টমেটোর বীজের দাম ৭০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ বছর তিনি নিজের টাকা দিয়েই বিভিন্ন জাতের পাঁচ কেজি বীজ কিনে চারা উৎপাদন করেছেন। শুরুতে তাঁর খামারে দুটি মাত্র শেড ছিল। এখন শেডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০টিতে।

আলিফ বলেন, ‘এখনো জমিজমা কিছু করতে পারিনি, এটা ঠিক। ভাঙা ঘরে থাকি। কিন্তু এত দিনে ব্যবসাটা মোটামুটি দাঁড়াই গেছে। ধারদেনা করে শুরু করছিলাম। জিরো থেকে ব্যবসাটাকে দাঁড় করে ফেলেছি। নিজে চাকরি করছি। এখন ২০-২৫ জন মানুষ আমার এইখানে কাজ করে। ভবিষ্যতে জমি, বাড়ি সবই হবে।’