ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিকারিদের সাংকেতিক ভাষার গল্প

বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন জানিয়েছেন, বনের ভেতরে শিকারে গিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত সাংকেতিক ভাষার আদ্যোপান্ত।

বনের ভেতরে শিকারে ব্যস্ত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুই ব্যক্তি। গত শনিবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরের গোসিংগা এলাকায়প্রথম আলো

দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রাচীন পেশা বন্য প্রাণী শিকার। বর্তমানে এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কেউ কেউ ঐতিহ্য বিবেচনায় শখ করে বনে শিকারে যান। গহিন বনে শিকারের সময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে নিজস্ব চিরাচরিত সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গাজীপুরের শ্রীপুরের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন জানিয়েছেন বনের ভেতর শিকারে গিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত সাংকেতিক ভাষার আদ্যোপান্ত।

শ্রীপুর ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলাটিতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় দুই হাজার মানুষের বাস। তাঁদের মধ্যে আছে মান্দি, কোচ, রাজবংশী, হাজং, বর্মন, ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লোকজন। উপজেলার টেংরা, কেওয়াচালা, বৈরাগীরচালা, বিন্দুবাড়ি, লোহাগাছ, ভিটিপাড়া, আক্তাপাড়া, কপাটিয়াপাড়া, শিমলাপাড়া, বদনীভাঙ্গা, ভেড়ামতলী এলাকায় তাঁদের বসতি।

গতকাল মঙ্গলবার কেওয়াচালা গ্রামে মান্দি জাতিগোষ্ঠীর লেনুস স্কু নামের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তিনি মাঝেমধ্যে সঙ্গীসহ শ্রীপুরের বিভিন্ন বনে শিকারে যান। গত সোমবার গাড়ারন এলাকার গজারি বন থেকে দুটি বড় আকারের কচ্ছপ শিকার করে এনেছেন। তাঁদের ভাষায় কচ্ছপকে ‘চেপ্‌পা’ বলা হয়।

লেনুস স্কু জানান, বনের গভীরে বিভিন্ন বন্য প্রাণী খুঁজতে গিয়ে প্রায় সময়ই শিকারিদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। তখন শিকারকে নিজেদের অবস্থান না বুঝিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তাঁরা কিছু সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। এসব সাংকেতিক ভাষা খুবই ছোট ছোট অদ্ভুত শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কিছু শব্দ তাঁরা মুখে উচ্চারণ করেন; কিছু শব্দ উৎপন্ন করেন দুই হাতের তালি, আঙুলে তুড়ি মেরে কিংবা লাঠির মাধ্যমে।

কয়েকটি সাংকেতিক ভাষা দেখিয়ে লেনুস স্কু বলেন, দুই ঠোঁটকে বিশেষ ভঙ্গিমায় অনবরত বাঁকিয়ে ‘ওওওঁ’ ধ্বনি তুলে এক শিকারি অন্য শিকারিকে নিজের অবস্থান জানান দেন। এই শব্দে এক শিকারি আরেক শিকারির অবস্থান বুঝতে পারেন। ওই শব্দ অনুযায়ী একজন শিকারি অন্যজনের দিকে রওনা করলে একই শব্দ কিছুটা ভিন্নভাবে উচ্চারণ করে জানান দেন। দুর্গম ও গভীর বনের ভেতর শিকারের সময় এই সাংকেতিক ভাষা নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

কোচ বংশের অপর শিকারি জিসকেল বর্মন তাঁদের সাংকেতিক ভাষা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, সাংকেতিক শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় কোথাও কোনো শিকার দেখতে পেলে সেটিকে ধরার সময় আশপাশের অন্য শিকারিদের সচেতন করার জন্য, যাতে কোনো শিকারি অসতর্ক হয়ে শিকারের কাছে চলে না আসেন। এ সময় বিশেষ ভঙ্গিমায় হাতের তালুতে তিনবার তালি দেওয়া হয়। এর অর্থ হলো, শিকার ধরার কাজ চলছে। এখানে আসা যাবে না।

সুজিত গাবিলের বয়স ৮৩ বছর। তিনি মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শিকারি। বয়স বেশি হওয়ায় এখন বাড়িতেই থাকেন। ছোট বয়সে তিনি নিয়মিত শিকারে যেতেন। তখন চারপাশে ভাওয়ালের ঘন বন ছিল। আগের মতো বন নেই। ফলে শিকার ঐতিহ্য হলেও এখন বেশির ভাগই আর করেন না। তিনি জানান, শিকারের সময় নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে অন্য শিকারিদের সঙ্গে ‘ঠুই ঠুই’, ‘উইক উইক’ শব্দ করে যোগাযোগ করতেন। এ ছাড়া ‘কুইচ্চা’ ধরার সময় গর্তের সামনের পানিতে এক আঙুল দিয়ে ‘চঅপাৎ চঅপাৎ’ শব্দ করা হয়। এতে কুইচ্চা গর্ত থেকে বের হয়ে আসে। সাংকেতিক ভাষা সম্পর্কে সুজিত গালিব আরও বলেন, অনেক সময় শিকারে গিয়ে হাতে থাকা দুটি লাঠির মাধ্যমে একধরনের বিশেষ শব্দ করা হয়। শিকার শেষ হলে সবাইকে একসঙ্গে জড়ো হওয়ার জন্য এই সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী শিকারিদের এসব সাংকেতিক ভাষার বিষয়ে শ্রীপুর ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান মানিক সাংমা বলেন, ‘আমরা নিজস্ব সংস্কৃতির মতো আমাদের ভাষাকেও খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। নিজেরা এ ভাষার চর্চা করি। যুগ যুগ ধরে এসব ভাষা এখনো সমুন্নত।’

শ্রীপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবেশী হওয়ায় তাঁদের সাংকেতিক ভাষা ছোট থেকে দেখে এসেছেন কলেজশিক্ষক মিশকাত রাসেল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁরা এই সময়ে এসে প্রয়োজনের তাগিদে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তবে তাঁদের নিজস্ব ভাষাগত ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার বিষয়টি প্রশংসনীয়।