সরঞ্জাম থাকলেও বন্ধ অস্ত্রোপচার

গত বছরের জুলাই থেকে বন্ধ অস্ত্রোপচার। কারণ, অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক নেই। এতে ভুগতে হচ্ছে উপজেলাবাসীকে।

চিকিৎসাসংকটে ভুগছে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচার কক্ষে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকলেও নেই অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক। ফলে বন্ধ রয়েছে অস্ত্রোপচার কার্যক্রম। এতে ভোগান্তিতে শিকার হচ্ছেন উপজেলার বাসিন্দারা। বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন প্রসূতিরা।

শুধু অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসকই নন, এই হাসপাতালে ৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৬ জন। ফলে শুধু অস্ত্রোপচারই বন্ধ নয়, অন্যান্য চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। অতিরিক্তি অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে তাঁদের। অনেক রোগীকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হচ্ছে।

প্রসূতি স্ত্রী নিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পর জানতে পারি অস্ত্রোপচার বন্ধ। পরে জেলা শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাই।
স্বপন মিয়া, ভুক্তভোগী

গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালটির পূর্ব পাশের ভবনের দোতলায় সুসজ্জিত অস্ত্রোপচার বিভাগ। দুটি অস্ত্রোপচার কক্ষই তালাবদ্ধ রয়েছে। অস্ত্রোপচারের সব যন্ত্রপাতি পাশের একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের জুলাই থেকে বন্ধ অস্ত্রোপচার। কারণ, অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক নেই।

সম্প্রতি উপজেলার জিয়নপুর ইউনিয়নের পংতিরচা গ্রামের স্বপন মিয়ার স্ত্রী রিক্তা আক্তারের প্রসবব্যথা দেখা দিলে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান স্বজনেরা। স্বপন মিয়া বলেন, ‘প্রসূতি স্ত্রী নিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পর জানতে পারি অস্ত্রোপচার বন্ধ। পরে জেলা শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হয়।’

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ উপজেলাটি যমুনা নদীভাঙনের শিকার। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি এবং জমিজমা হারিয়ে অনেক পরিবার দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে বাচামারা, বাঘুটিয়া ও চরকাটারি—এ তিনটি ইউনিয়ন যমুনা নদীবেষ্টিত দুর্গম এলাকা। এসব ইউনিয়নের বাসিন্দাদের চিকিৎসাসেবা নিতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও চিকিৎসাসেবা না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা।

দৌলতপুর উপজেলাটি নদীভাঙন এলাকা। ওই এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব অপরিসীম
দীপক কুমার ঘোষ, সহসভাপতি, জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম

শয্যা বাড়লেও সেবা বাড়েনি

১৯৮৩ সালে ৩১ শয্যা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির কার্যক্রম শুরু হয়। এর পর ২০১৩ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও চিকিৎসক ও লোকবল তেমন বাড়েনি। ফলে শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে চিকিৎসাসেবার তেমন অগ্রগতি হয়নি।

উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, এ উপজেলায় জনসংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৯১৩ জন। এই হিসাবে, দৌলতপুর উপজেলায় প্রতি ২৭ হাজার ৭৪৪ জনের জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন।

জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের সহসভাপতি দীপক কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, দৌলতপুর উপজেলাটি নদীভাঙন এলাকা। ওই এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব অপরিসীম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসক পদায়ন এবং সেবার মানসিকতা নিয়ে কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হতে পারে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের ৩০টি পদের মধ্যে ১৪টি পদেই চিকিৎসক নেই। হাসপাতালে পদায়ন করা ২০ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন ১৬ জন। চারজন চিকিৎসক প্রেষণে অন্যত্র দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) এ বি এম শাফিউজ্জামান রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে, চিকিৎসা কর্মকর্তা (হোমিও) ঢাকার সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং সহকারী সার্জন গোধূলি বিশ্বাস ও সহকারী সার্জন জান্নাতুল ফেরদৌস মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালটিতে ১০টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন) পদে দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া সহকারী সার্জন পদে দুটি ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে দুটি পদও শূন্য। দীর্ঘ দিন ধরে ডেন্টাল সার্জনও নেই।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ আসাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২২০ থেকে ২৫০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রতিদিন ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা থাকে গড়ে ২০ থেকে ৩৫ জন।

হাসপাতালের এক্স–রে যন্ত্রটি নিয়েও ভুগতে হয় জানিয়ে আসাদ হোসেন বলেন, অ্যানালগ এক্স-রে যন্ত্রটি তিন যুগ আগের। মাঝেমধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এই এক্স-রের পরিবর্তে ডিজিটাল এক্স-রে প্রয়োজন। এতে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

চিকিৎসকসংকটের বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহ আলম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের পদায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিকবার লিখিতভাবে জানিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।