জামুর্কীর ‘অপূর্ব স্বাদের’ সন্দেশ

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কীতে অবস্থিত ‘কালিদাস মিষ্টান্ন ভান্ডারের’ সন্দেশছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের দেব পাহাড় এলাকা থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুরে যাচ্ছেন মাসুদ মিয়া (৫০) নামের এক ব্যক্তি। সঙ্গে তাঁর বন্ধু। তাঁদের ভাবনায় ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কীতে গিয়ে সন্দেশ খাবেন। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা জামুর্কীতে পৌঁছান। ‘কালিদাস মিষ্টান্ন ভান্ডার’–এ ঢুকেই সন্দেশ খেতে চাইলেন। দোকানের কর্মচারী টিস্যুতে তুলে দিলেন গুড় ও চিনির তৈরি একটি করে সন্দেশ।

আরও পড়ুন

সেই সন্দেশ খেতে খেতে মাসুদ মিয়া বললেন, ‘বহু প্রশংসা শুনেছি। এত ভালো সন্দেশ, ভাবতেই পারিনি! সত্যিই অপূর্ব স্বাদ!’

প্রায় ৩৫ বছর আগে দোকানটির সন্দেশ খেয়েছিলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য গোলাম মোস্তফা (৭৩)। পূর্বপরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা করতে জামুর্কীতে এসেছেন তিনি। পুরোনো সেই স্বাদ পেতে এক কেজি সন্দেশ কিনলেন। তিনি বলেন, ‘আগে যখন এই রোডে ট্রাক চালাইতাম, তহন নিয়মিত খাইতাম। অহন ট্রাক চালাই না। এই সন্দেশও খাই না।’

আরও পড়ুন

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বললেন, জামুর্কী গ্রামের বাসিন্দা মদনমোহন সাহা মিষ্টির ব্যবসা করতেন। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর ছেলে কালিদাস চন্দ্র বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাঁর বাবা তাঁকে সংসার থেকে আলাদা করে দেন। সে সময় কালিদাস সারা দিন স্থানীয় একটি মিষ্টির দোকানে বসে থাকতেন। সেখানে বসে থাকতে থাকতেই তিনি সন্দেশ তৈরির পদ্ধতি শেখেন। ১৯৪০ সালে কালিদাস চন্দ্র সাহা নিজেই সন্দেশ তৈরি ও বিক্রি শুরু করেন। এই মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। ১৯৮২ সালে তিনি মারা যান। তারপর তাঁর বড় ছেলে সমর চন্দ্র সাহা ব্যবসার হাল ধরেন। আরেক ছেলে গৌতম সাহা লন্ডনপ্রবাসী।

সমর চন্দ্র সাহা বলেন, ব্যবসা শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠেন। বাবার মৃত্যুর পর ছাত্রাবস্থায় তিনি দোকানে বসতে শুরু করেন। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁদের দোকান খোলা থাকে। চিনি ও গুড়ের তৈরি দুই ধরনের সন্দেশ পাওয়া যায় তাঁদের দোকানে। তাঁরা ৭৫০ টাকা কেজি দরে এই সন্দেশ বিক্রি করেন।

কালিদাস মিষ্টান্ন ভান্ডারের গুড়ের সন্দেশ
ছবি: প্রথম আলো

তাঁদের দোকানের মিষ্টি সাধারণ মানুষের যেমন পছন্দ, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যও এই দোকানের মিষ্টি যায় বলে জানালেন সমর চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জামুর্কী বাসস্ট্যান্ডে এক অনুষ্ঠানে এসে আমাদের দোকানের সন্দেশ খান। ওই সময় আমার বাবা চিনি ও গুড় দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি পাঁচ কেজি ওজনের দুটি সন্দেশ বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল পরিদর্শনে এলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করেন। শিল্প-সাহিত্যজগতের অনেকেই আছেন, যাঁরা আমাদের মিষ্টি পছন্দ করেন।’

দোকানের কর্মচারীরা বলেন, প্রায় প্রতি ঘণ্টায় চুলা থেকে একটি করে বড় কড়াই নামানো হয়। এ থেকে প্রায় ৩০ কেজি সন্দেশ বানানো যায়। তাঁরা সন্দেশ তৈরির জন্য প্রথমে দুধ থেকে ছানা তৈরি করেন। এর মধ্যে এলাচি, চিনি অথবা গুড় দিয়ে মিশ্রণ তৈরির পর সন্দেশ তৈরি করেন।

আরও পড়ুন

যে দোকানে সন্দেশের ব্যবসা হয়, তা চৌচালা টিনের ঘরের পুরোনো দোকান। বাড়তি কোনো চাকচিক্য নেই। সাদামাটা কাচঘেরা তাকে সাজিয়ে রাখা হয় সন্দেশ। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে থাকা দোকানটিতে লোকজন গাড়ি থামিয়ে সন্দেশ কিনে নিয়ে যান। দোকানটিতে সন্দেশ ছাড়াও চমচম, রসগোল্লা, রসমালাই, কালোজাম, দই ও ঘি বিক্রি হয়।