চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড
তিন টাকার স্ক্রু কেনা হয় আট টাকায়
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে স্ক্রু, কম্পিউটার, টোনার ও এসি কেনা হয়েছে। তিন টাকার স্ক্রু কেনা হয়েছে আট টাকায় এবং এসির দাম দেখানো হয়েছে দ্বিগুণ।
আকারে এক ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি স্ক্রু। স্থানীয় বাজারের হার্ডওয়্যারের দোকান কিংবা অনলাইন শপগুলোতে একটি ভালোমানের স্ক্রুর দাম দুই টাকার মতো। সর্বোচ্চ দাম তিন টাকা, তবে এই মাপের স্ক্রু চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড কিনেছে প্রায় আট টাকা দামে। গত জুলাইয়ে বোর্ডের কম্পিউটার সেলে ল্যান ওয়্যারিংয়ের জন্য কেনা এক হাজার স্ক্রুতে বোর্ড খরচ করেছে ৮ হাজার ৩০০ টাকা। কেবল স্ক্রু নয়, বাড়তি দামে কেনা হয়েছে সব সরঞ্জাম। পুরো কাজে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।
একটি দপ্তরের একাধিক কম্পিউটার বা ডিভাইসকে যুক্ত করে ডেটা শেয়ার করার জন্য যে কেব্ল সিস্টেম ব্যবহার হয়, তাকে বলা হয় ল্যান ওয়্যারিং। গত জুলাইয়ে বোর্ডের সপ্তম তলার কম্পিউটার সেলে ল্যান ওয়্যারিংয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ কাজের জন্য সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ব্যয় করা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪২৫ টাকা। ১৪ ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় এ টাকা খরচ করেছে শিক্ষা বোর্ড।
কার্যাদেশে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে নেটওয়ার্ক সুইচ কেনায়। পাঁচটি নেটওয়ার্ক সুইচ কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া নেটওয়ার্ক কানেক্টর, চ্যানেল বিট, রয়্যাল প্লাগসহ নানা যন্ত্রপাতি কেনায় টাকা খরচ হয়েছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটিতেই দাম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
এর বাইরেও শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কাজে যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও সংস্কারকাজে ব্যয় হয়েছে বাজারদরের চেয়ে বেশি। গত মে থেকে জুলাই মাসে কম্পিউটার, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি, গোডাউন মেরামতের জন্য জিনিসপত্র কিনতে এমন খরচ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রত যন্ত্রের (এসি) কেনাকাটায়।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চলতি বছরের মে মাসে পটিয়ার ইসলাম ট্রেডিং থেকে ৫টি কম্পিউটার ও ৪০টি টোনার কিনেছে। কম্পিউটারের কনফিগারেশনে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্টেল কোর আই-৫ (তৃতীয় জেনারেশন), ৩ পয়েন্ট ২০ গিগাহার্টজ প্রসেসর, ৮ জিবি র্যাম, ২ টেরাবাইট হার্ডডিস্ক, ২৫৬ জিবি এসএসডি, ‘এফোর টেক’ ব্র্যান্ডের কি-বোর্ড ও মাউস এবং ‘জিংসা’ ব্র্যান্ডের মাদারবোর্ড, তবে মনিটরের উল্লেখ করা হয়নি।
বোর্ড প্রতিটি কম্পিউটারের দাম ৭০ হাজার টাকা এবং প্রতিটি টোনারের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকা ধরেছে। কিন্তু বাজারে একই কনফিগারেশনের কম্পিউটার মনিটরসহ সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। যেসব টোনারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় পাওয়া যায়। ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকার কেনাকাটায় বাজারদরের চেয়ে আড়াই লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইসলাম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী শামসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজার যাচাই করে সমন্বয় করে কোটেশন দেওয়া হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আমরা কাজ পেয়েছি।’
এর পাশাপাশি ঢাকা রেস্ট হাউস ও চট্টগ্রামে ইবাদত খানা ও কলেজ পরিদর্শকের কক্ষে ১০টি গ্রি ব্র্যান্ডের এসি কিনেছে বোর্ড। এর মধ্যে ৬টি এসি সরবরাহের আদেশ পেয়েছে ঢাকার ব্লু পিক ইনোভেশন। আর ৪টি সরবরাহ করেছে নগরের বহদ্দারহাট এলাকার চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ। এসির ক্রয়ের মোট খরচ (ভ্যাট, ট্যাক্সসহ) হয়েছে ১২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। কার্যাদেশ অনুযায়ী প্রতিটি ২ টনের এসি ১ লাখ ২৫ হাজার ও দেড় টনের এসি ১ লাখ ১৯ হাজার টাকা দরে দেখানো হয়েছে।
নগরের বিভিন্ন এসি বিক্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাগজপত্রে যে এসির কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর দাম ৫৮ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও স্থাপন খরচ বিনা মূল্যেই করা হয়। অর্থাৎ ১২ লাখ ২৬ হাজার টাকার এসি কিনতে বাজারদরের চেয়ে ৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বোর্ডের পণ্য মান যাচাই–বাছাই কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘কার্যাদেশে যা লেখা আছে, সেটি ঠিকঠাক এসেছে কি না, তা দেখা এই কমিটির কাজ। বাকি বিষয়গুলো এই কমিটির এখতিয়ার নেই।’
বোর্ড সূত্র জানায়, সাধারণত তিন ধরনের কেনাকাটা হয়। ২৫ হাজার টাকার নিচে কেনাকাটা জরুরি কেনাকাটা ধরা হয়। ২৫ হাজার থেকে ৫ লাখের মধ্যে স্বল্প কেনাকাটা। ৫ লাখের বেশি হলে সেটি সরকারিভাবে ই-টেন্ডার (উন্মুক্ত দরপত্র) আহ্বানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ওপরের অধিকাংশ কেনাকাটা হয়েছে স্বল্প কেনাকাটার আওতায়। বোর্ড জানায়, পত্রিকায় অথবা নোটিশ বোর্ডে শিক্ষা বোর্ড কোটেশন আহ্বান করে। দরপ্রস্তাব দিতে হয় বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বোর্ডের চেয়ারম্যান ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতে তিন দফা বোর্ডে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে গত বুধবার বিকেলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘ঝামেলায় আছি, পরে কথা বলব’, জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে না পেয়ে বোর্ডের সচিব সামছু উদ্দিন আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। বক্তব্য জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোর্ডে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, কমবেশি সবাই শিক্ষক। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা পাঠ দেন। শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হয়ে থাকা শিক্ষকেরা এমন দুর্নীতি করছেন, এটি অবাক করার বিষয়। সরকারি কাজে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, এটি অন্যায়।’