ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতেই মশা মারায় গাছাড়া ভাব

চট্টগ্রাম নগরের ওয়াসা মোড় এলাকায় অবস্থিত সিটি করপোরেশন স্টোর রুমে এভাবে পড়ে আছে মশা মারার ফগার মেশিন। মশার উৎপাত বাড়লেও দমনের কোনো কার্যক্রম নেই। গতকাল বেলা ১টায়ছবি-সৌরভ দাশ

মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকা। এখানের একটি ক্যানটিনে নাশতা করতে যান ফাহিম উদ্দিন ও তাঁর বন্ধুরা। কিন্তু মশার উৎপাতে টেবিলে বসা দায় হয় তাঁদের। মশা তাড়াতে জ্বালাতে হয় কয়েল। শুধু ক্যানটিনে নয়, বাসাতেও মশা নিয়ে যন্ত্রণায় আছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফাহিম।

ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরের বহদ্দারহাটের খাজা সড়কের বাসিন্দা ফাহিম উদ্দিন বলেন, বছরজুড়েই মশা নিয়ে আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় থাকতে হয় তাঁদের। আগে অন্তত মাসে এক-দুইবার ওষুধ ছিটাত সিটি করপোরেশন। কিন্তু এখন তা–ও দেখা যাচ্ছে না।

ফাহিম উদ্দিনের বক্তব্যের সূত্র ধরে নগরের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের মশা মারার কার্যক্রম আগের তুলনায় ঝিমিয়ে পড়েছে। নালা-নর্দমা আর ভবনের আশপাশে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে একেবারে কম। এতে মশার উৎপাত বেড়ে চলছে।
নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলী,  চান্দগাঁও, মোহরা, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, হামজারবাগ, নন্দনকানন, লাভ লেন, জামালখান, কাজীর দেউড়ি, হালিশহর, পতেঙ্গা, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, উত্তর কাট্টলী, ফরিদারপাড়া, বাকলিয়া, কে বি আমান আলী সড়ক, চকবাজার এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। একই অবস্থা নগরের অন্যান্য এলাকায়ও।

মূলত ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসায় মশা নিধনের ব্যাপারে সিটি করপোরেশন গাছাড়া ভাব চলে এসেছে। তাদের এখন প্রস্তুতি আগামী মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পনা কম। এতে এখন কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিউলেক্স মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের পাশাপাশি চর্মরোগের ঝুঁকি রয়েছে। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এ মশার উপদ্রব। চট্টগ্রামেও গবেষণা করা হলে এই ধরনের চিত্র পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান গবেষকেরা। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, এখন যে মশার উৎপাত বেড়েছে তা কিউলেক্স মশা।

কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, দেশে মোটামুটিভাবে ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। এর মধ্যে ১৬ প্রজাতির মশা বেশি দেখা যায়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে যে কয়েক প্রজাতির মশা থাকে, এর মধ্যে কিউলেক্সই ৯৫ শতাংশের বেশি। তীব্র শীতের মধ্যেও কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির যে হার, তাতে শীত কমলে তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা কীটতত্ত্ববিদদের। দেশে কিউলেক্স মশার প্রভাব দেখা দেয় অক্টোবর থেকে। অবশ্য শীতের তীব্রতা বাড়লে মশার কামড়ের মাত্রা কমে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকেই কিউলেক্সের দাপট বাড়ে। এপ্রিলে কালবৈশাখীর কারণে অনেক স্থানে এ মশা কমে আসে।

কিউলেক্স মশার কামড়ে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ ও জাপানি এনসেফালাইটিস হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুটি রোগ বাংলাদেশে প্রকট নয়। কিউলেক্সের বড় সমস্যা এরা সংখ্যায় বিপুল ও ব্যক্তির জন্য উৎপাতকারী। অবশ্য এই মশার কামড়ে অনেকের অ্যালার্জিজনিত অসুখ হয় বলে জানান চিকিৎসকেরা।

সিটি করপোরেশনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, মশকনিধন কার্যক্রম চললেও কিছুটা গতি কমেছে। পর্যাপ্ত ওষুধ ও জনবলসংকটের কারণে এই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে এডিস মশার প্রজনন না বাড়লেও কিউলেক্স মশার হার বেড়ে গেছে।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, উড়ন্ত বা পূর্ণ বয়স্ক মশা এবং লার্ভা নিধনের জন্য  তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় লার্ভা মারার জন্য। লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) পর্যাপ্ত থাকলেও অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধের সংকট রয়েছে।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মীরা জানান, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর জন্য মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে আছে তিন হাজার লিটার। প্রয়োজনের তুলনায় ওষুধ কম থাকায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে কম। তাই ওয়ার্ডগুলো ওষুধ ছিটানো হচ্ছে কম।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মশার লার্ভা মারার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। অ্যাডাল্টিসাইডের কিছুটা সংকট আছে। তবে ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড কেনার প্রক্রিয়া চলছে। আর এখন যাতে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে নষ্ট করার জন্য নালা-নর্দমা ও খালগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে।  

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মশকনিধন কার্যক্রমে গতি আনতে ৬০টি ফগার মেশিন ও ১০০টি স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড এবং ৩ হাজার লিটার লার্ভিসাইড কেনা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর সময় হলে তৎপর হবে আর বছরের অন্য সময় সে তৎপরতা থাকবে না, তা তো হতে পারে না। বছরজুড়ে মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। আবার ডেঙ্গুর সময়েও যে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা যথেষ্ট নয়। প্রকোপ বাড়লে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম জাতীয় কর্মসূচি পালন করে। এরপর আবার সব থমকে যায়। এভাবে মশকনিধন হবে না। আর এখন থেকে যদি পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে মশা মারার কার্যক্রম হাতে না নেয়, তাহলে গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সে রকম তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

গত বছর (২০২৩ সাল) চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮২ জন। মূলত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাঁদের এই তালিকাভূক্ত করা হয়েছিল। অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও বাসায় চিকিৎসা নেন। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯২ জন এবং মারা গেছেন ২ জন।