নিজের জামানতও রক্ষা করতে পারেননি আলোচিত প্রার্থী আখতারুজ্জামান

কিশোরগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে স্লোগান ধরেন। আবার একই মঞ্চ থেকেই ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই’ স্লোগানে গলা ফাটান। নিজের জয়ের ব্যাপারে ছিলেন শতভাগ আত্মবিশ্বাসী। অধিকাংশ সভায় বলে বেড়াতেন ঘুমিয়ে থাকলেও নাকি জয় ঠেকানোর সুযোগ নেই। বিএনপি থেকে ষষ্ঠবার বহিষ্কার হওয়া দেশব্যাপী আলোচিত–সমালোচিত সেই নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান ভোট শেষে নিজের জামানত রক্ষা করতে পারেননি।

স্বতন্ত্র পরিচয়ে আখতারুজ্জামান ভোটে দাঁড়ান কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে। ট্রাক প্রতীকে ভোট পান ১৬ হাজার ১৯৯। জামানত বাঁচাতে তাঁর দরকার ছিল অন্তত ২২ হাজার ৩৮৫ ভোটের।

কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিজয়ী হন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো. সোহরাব উদ্দিন। ঈগল প্রতীকে তাঁর ভোট ৮৯ হাজার ৫৩৯। তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনে চেয়েও দলীয় মনোনয়ন পাননি। তাঁর সঙ্গে নৌকার প্রার্থী সাবেক ডিআইজি ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দের ভোটের ব্যবধান ২০ হাজার ৬০৭। এই আসনে সাত প্রার্থীর মধ্যে আখতারুজ্জামান ছাড়াও জমানত হারান আরও পাঁচ প্রার্থী।

আরও পড়ুন

কিশোরগঞ্জ জেলায় সংসদীয় আসন ছয়টি। এবারের নির্বাচনে জেলাবাসীর বিশেষ আগ্রহের জায়গা ছিল কিশোরগঞ্জ-২। মূলত আখতারুজ্জামানকে ঘিরে আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়। মনোনয়নপত্র কেনার পর থেকে নতুন নতুন আলোচনার জন্ম দিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকা ছাপিয়ে দেশবাসীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সক্ষম হন তিনি। এই আসনের ফলাফল জানা নিয়েও ছিল মানুষের বাড়তি কৌতূহল ছিল। জামানত হারানোর খবরের মাধ্যমে নির্বাচন–পরবর্তী আলোচনায় আবার তিনি সামনে আসেন। ভোটারদের মন না পাওয়ার কারণ এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিষয় নিয়ে আলোচনা এখন মানুষের মুখে মুখে।

স্থানীয় লোকজন জানালেন, এলাকায় আখতারুজ্জামানের পরিচয় স্পষ্টবাদী ও একরোখা স্বভাবের মানুষ হিসেবে। বেফাঁস কথা বলা তাঁর অভ্যাস। কখন কী করবেন আর কাকে কী বলে বসবেন—আগ থেকে ধারণা করা কঠিন। বেতাল কথাবার্তার কারণে কখন কার বিপদ আসন্ন হয়ে ওঠে, তাঁকে ঘিরে এমন শঙ্কাও আছে কর্মীদের মনে। এই অবস্থায় এবার এমন অনিশ্চিত ও রহস্যময় নেতার কর্মী হতে চাননি তাঁর বেশির ভাগ অনুগত। ভোটে সুবিধা করতে না পারার কারণ হিসেবে বিষয়টিকে সামনে এগিয়ে রাখছেন অনেকে।

মনে করা হচ্ছে, দল হিসাবে বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও আখতারুজ্জামান দলটির কর্মী–সমর্থকদের কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আখতারুজ্জামানের ধারণা ছিল, কেন্দ্রে বিএনপির লোকজন তাঁকেই ভোট দেবে। বিএনপির মন পাওয়ার জন্য সভায় তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইতেন। আবার নৌকার ভোট পেতেও নিয়েছেন ভিন্ন কৌশল। যে মঞ্চে তিনি খালেদার মুক্তির কথা বলতেন, একই মঞ্চে শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। তাঁর এই দ্বিচারী মনোভাব বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস হারান। ফলে এবার বিএনপি তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে।

আরও পড়ুন

জয়ের ব্যাপারে আখতারুজ্জামানের আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী। প্রায় সভায় বলতেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর জয় চান। ঘুমিয়ে থাকলেও তাঁর জয়ে কেউ বাধা হতে পারবেন না। তাঁর কর্মী–সমর্থকেরা বিশ্বাস করতেন তিনি সরকারের ‘গুডবুকের লোক’। ভোটের মাঠে প্রচার ছিল, বিশেষ কারণেই সরকার তাঁকে এই আসন থেকে বিজয়ী করে সংসদে নেবে। প্রার্থী এবং কর্মীদের এমন ভিত্তিহীন আত্মবিশ্বাস ভোটে এমন ভরাডুবি ত্বরান্বিত করে বলে ধারণা অনেকের।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ সদস্য পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন। নৌকা না পাওয়ায় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যান। পরবর্তী সময়ে তিনি নৌকার হয়ে কাজ না করে সমর্থন দেন আখতারুজ্জামানকে। এই সমর্থনে ট্রাক প্রতীকের প্রচারণায় গতি আসে সত্য, কিন্তু ভোটে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ হিসেবে আলোচনায় সামনে আসছে সংসদ সদস্যকে ঘিরে কটিয়াদী পাকুন্দিয়ায় একটি বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। বাহিনীর সদস্যদের যন্ত্রণায় এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। নূর মোহাম্মদ সমর্থন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর লোকজন ট্রাকের হয়ে কাজ শুরু করেন। এটি সাধারণ ভোটারকে ভাবায়। ফলে সংসদ সদস্যের সমর্থন আদতে আখতারুজ্জামানের জন্য বড় সুবিধার হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কটিয়াদী উপজেলা বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, নির্বাচনে আখতারুজ্জামান নানা ঘটনা রটনার জন্ম দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে খুশি রাখতে চেষ্টা করেছেন। মানুষ এত নাটক পছন্দ করে না। বিশ্বাস হারানোর কারণেই তিনি কোনো পক্ষের ভোট পাননি।

মুঠোফোন না ধরায় আখতারুজ্জামানের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে তাঁর সক্রিয় কর্মী কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ. কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা যা শুনে এসেছিলাম, শেষে বাস্তবে কিছুই হয়নি। শুরুতে অনেক জনপ্রতিনিধি আমাদের পক্ষে ছিল। শেষে ঈগলের ওপর ভর করে। এবার বিএনপিকেও পাওয়া যায়নি।’

আরও পড়ুন

যে কারণে নৌকাও হারল

নৌকার প্রার্থী আবদুল কাহার আকন্দ রাজনীতিতে নতুন, প্রার্থী হিসেবে প্রথম। ফলে ভোটে এসে তিনি নেতা-কর্মীর সঙ্গে সহজ হতে পারেননি। বিশেষ করে দলের লোকজনকে ধরে রাখার বিষয়ে কৌশলী ছিলেন না।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে একাধিক ধারায় বিভক্ত। দুই উপজেলার কোথাও প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতৃত্ব জোরালো ছিল না। একটি পক্ষ নৌকায়, আরেকটি পক্ষ ঈগল প্রতীকের হয়ে কাজ করে। বিশেষ করে বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ দলের প্রার্থীর পক্ষে না থেকে ছিলেন আখতারুজ্জামানের পক্ষে। এতে বিভক্ত দলটি আরও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ভোটের দিন। দিনটিতে কেন্দ্র ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী শূন্য। ফলে কেন্দ্রে ভোটার আনার ব্যাপারে দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিপরীতে দলের অনেক নেতা–কর্মী সোহরাব উদ্দিনের পক্ষে সরব ছিলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। নৌকার পরাজয়ে দলীয় নেতৃত্বের দুর্বলতাকে বড় কারণ মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

মূল তিন প্রার্থীর মধ্যে আবদুল কাহার আকন্দ ও আখতারুজ্জামানের বাড়ি কটিয়াদী। সোহরাব উদ্দিন পাকুন্দিয়ার বাসিন্দা। এবারের ভোটে আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকুন্দিয়ার একক প্রার্থী হিসেবে সোহরাব নৌকার চেয়ে ৩০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছে। আবার কটিয়াদীতে সোহরাবের চেয়ে নৌকা ১০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছে। আখতারুজ্জামানের ১৬ হাজার ১৯৯ ভোটের মধ্যে পাকুন্দিয়া থেকে পাওয়া ভোট মাত্র ১ হাজার ৬০০ ভোট।

কটিয়াদী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমেদ বলেন, ভোটে এবার আঞ্চলিকতার ছাপ স্পষ্ট। নৌকার পরাজয়ের জন্য তিনি দায়ী করেন সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদকে। তাঁর মতে, দলের সংসদ সদস্য হয়ে বিপরীত রাজনীতির একজনের পক্ষ নেওয়ার মানে দলের সর্বনাশ করে দেওয়া।

চেষ্টা করেও নূর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে আখতারুজ্জামানের পক্ষ নেওয়ার বিষয়ে আগে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেছিলেন, নৌকার প্রার্থী পছন্দ না। এ কারণে তিনি নৌকা ছেড়ে ট্রাকের হয়ে কাজ করেন।