‘ভাইকে জোর করে কাজে এনেছি, এখন বাবা–মায়ের কাছে কী জবাব দেব’

রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে স্বজনদের অপেক্ষা। খাগড়াছড়ি জেনারেল হাসপাতাল প্রাঙন থেকেছবি: সুপ্রিয় চাকমা।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের সিঁড়ির পাশে মেঝেতে একটা শয্যা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল সাজেকে ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত জাহিদ হাসানকে (২৪)। দুই পায়ে ব্যান্ডেজ আর প্লাস্টার মোড়ানো তাঁর। হাতের শিরায় চলছে স্যালাইন। ঝুঁকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কান্না কেবল চোখ নয়, কণ্ঠকেও রুদ্ধ করেছে তাঁর। ধরাগলায় বললেন, ‘আমি কী করে ছোট ভাইকে মরতে টেনে আনলাম বাড়ি থেকে। সে তো আসতে চায় নাই। এখন বাবা–মাকে কী জবাব দেব।’

জহিদের ছোট ভাই তপু হাসান এ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সী ছোট ভাইকে নিয়ে ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে থেকে সাত মাস আগে খাগড়াছড়ি এসেছিলেন সীমান্ত সড়কে কাজ করবেন বলে। এর মধ্যে ঈদের ছুটিতে বাড়িও গিয়েছিলেন তাঁরা। বাড়িতে গিয়ে ছোট ভাই আসতে চায়নি। জাহিদই জোর করে নিয়ে এসেছেন। ভাইকে বলেছিলেন, বসে থাকলে খাব কী? এখন সেই কথাটা বারবার মনে পড়ছে তাঁর। নিজের শারীরিক যন্ত্রণার কথা ভুলে গেছেন ভাইয়ের শোকে। ভাইকে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন তিনি নিজেই। সেই ভাই তো তাঁর সন্তানেরই মতো। জাহিদ ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আল্লায় আমারে নিল না, আদরের ভাইটারে নিয়া গেল ক্যান।’

খগড়াছড়ি হাসপাতালে আজ দুপুরে আহত শ্রমিকদের যতটা সম্ভব সেবা দিচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা। জাহিদকেও বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন চিকিৎসক ও নার্সরা। কিন্তু তাঁকে থামানো যাচ্ছিল না। গতকালের দুর্ঘটনার দৃশ্য যেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি।

রাঙামাটির বাঘাইছড়ির দাড়িপাড়া এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মিনিট্রাক খাদে পড়লে সড়কের কাজ করতে আসা ৯ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও ছয়জন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার শিজকছড়া-উদয়পুর সড়কের সাজেক ইউনিয়নে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাস্থল রাঙামাটি হলেও খাগড়াছড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। এ কারণে হতাহত সবাইকে আনা হয় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে। সেখান থেকে নিহত নয়জনের লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উদয়পুর সীমান্ত সড়কের কাজ করার জন্য গতকাল খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে মিনিট্রাকে করে ১৫ জন শ্রমিক যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ট্রাকটি দাড়িপাড়া এলাকার ৯০ ডিগ্রি পাহাড়ে পৌঁছালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গভীর খাদে পড়ে যায়।

জাহিদ ও তাঁর নিহত ভাই তপুকে নিতে এসেছেন চাচাতো ভাই রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁর দুই চাচাতো ভাই খুব কষ্ট করে সংসার চালান। তাঁদের ঘরে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। ঘরে থাকা যায় না তখন। পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। দুই ভাই উদয়স্ত পরিশ্রম করে সংসারের চেহারা পাল্টাতে চেয়েছেন।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত মোবারক হোসেন (৩০) বলেন, ‘গাজীপুর থেকে আমরা এই গাড়িতে করে এসেছি। খাগড়াছড়ি এসে একজন গাড়িতে ওঠেন। আদৌ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব কি না জানি না।’  

বাঘাইছড়ি থানার সার্কেল সিনিয়র পুলিশ সুপার আবদুল আওয়াল চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় এখনো কেউ মামলা করেনি। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত সাতটি লাশ পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি একজনের পরিবার আসছে। একজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

খাগড়াছড়ি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রিপল বাপ্পী বলেন, বুববার রাতে ১০ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে; তার মধ্যে চারজন মারা গেছেন। আজ দুপুরে আহত ছয়জনকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য স্বজনেরা ঢাকা নিয়ে গেছেন।

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরিন আক্তার খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, বিআরটিএর পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা এবং আহতদের ২ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া লাশ বহনের জন্য প্রতি পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।