বন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে দেড় মাসে ছয়জনের মৃত্যু

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বন্য হাতির আক্রমণে ১৫০ ও শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়।

শেরপুর জেলার মানচিত্র

ময়মনসিংহ ও শেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় দেড় মাসের ব্যবধানে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে বন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে ছয়জন নিহত হয়েছেন। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোয় হাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হাতির ভয়ে প্রতি রাতে বাড়িতে থাকা গরু-ছাগল নিয়ে মসজিদ বা স্কুলের মাঠে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন গ্রামবাসী। বন্য হাতি তাড়াতে সরকার ও বন বিভাগের সহযোগিতার দাবি জানান এলাকাবাসী।

ময়মনসিংহ বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় দুটি ইউনিয়নে বন্য হাতির আক্রমণে ১৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া হাতির আক্রমণে ছয়টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় তিনটি ইউনিয়নে ৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়। ফসল রক্ষা করতে গিয়ে ছয়জন মারা যান।

হালুয়াঘাটের উত্তর নলকুড়া গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, সন্ধ্যার পর সীমান্তের কাঁটাতারের ভাঙা অংশ দিয়ে হাতিগুলো তাঁদের গ্রামগুলোয় চলে আসে। তখন গ্রামবাসী মসজিদ ও স্কুল মাঠে জড়ো হয়। এটা প্রায় প্রতি রাতের ঘটনা। হাতির ভয়ে তাঁদের রাত জেগে বসে থাকতে হয়।

বন বিভাগ সূত্র ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দুই মাস ধরে নালিতাবাড়ী ও হালুয়াঘাট উপজেলার বুরুঙ্গা, কালাপানি, চকিদারটিলা, মায়াঘাষি, পানিহাটা, ফেকামারী, ধোপাজুড়ি, কড়ইতলী, মহিষলেটি, লক্ষ্মীকুড়া, পূর্ব নলকুড়া, ডাইকাপাড়া, কুমনিকুড়া, কাতলমারী এলাকার সীমান্তবর্তী গভীর জঙ্গলে হাতির একটি পাল অবস্থান করছে। সন্ধ্যার পর এই হাতির পাল কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে। পালে ৬০ থেকে ৭০টি হাতি আছে। দিনের বেলা হাতিগুলো ভারতের মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী ফকিরাকুনা ও ডুমনিকুড়া জঙ্গলে চলে যায়।

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২২ এপ্রিল ঈদের দিন হালুয়াঘাটের গাবরাখালী গ্রামে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়ে মারা যান কৃষক ফরজুল ইসলাম (৩০)। এর চার দিন আগে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় মারা যায় সুমন আহমেদ (১২) নামের এক কিশোর। ১৪ এপ্রিল শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার মালাকোচা গ্রামে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারান কৃষক আবদুল করিম (২৮)। একই গ্রামে ১ মে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান কৃষক আবদুল হামিদ (৫৫)।

২৫ এপ্রিল হাতির আক্রমণে গুরুতর আহত হন নালিতাবাড়ী উপজেলার পূবশমচুড়া গ্রামের কৃষক বিজয় সাংমা (৫২)। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গত ২৭ এপ্রিল রাতে তিনি মারা যান। সর্বশেষ ২ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে হালুয়াঘাট উপজেলার বরাক গ্রামের ইদ্রিস আলী (৬০) প্রাণ হারান।

স্থানীয় লোকজন বলেন, দেড় মাসের ব্যবধানে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় সীমান্তবর্তী এলাকায় এখন বন্য হাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হাতি প্রতিরোধে বন বিভাগের কার্যকর কোনো ভূমিকা না থাকায় তাঁরা হতাশ। তাঁরা নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা চান।

হালুয়াঘাটের গাজিরভিটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, সীমান্তবর্তী মানুষ সন্ধ্যা নামার পর থেকে হাতির আতঙ্কে থাকন। কয়েক দিনের ব্যবধানে তাঁর ইউনিয়নে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এখানে ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে বন বিভাগের কোনো নজরদারি নেই। যদি সরকারিভাবে হাতি তাড়াতে হ্যান্ড মাইক, টর্চ অথবা জেনারেটর দেওয়া হতো তাহলে ভালো হতো।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ বন বিভাগের গোপালপুর বিট কর্মকর্তা মাজাহারুল হক বলেন, হাতি প্রতিরোধে এলাকাবাসীকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া হাতির আক্রমণে ফসল নষ্ট হলে বন বিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। হাতির আক্রমণে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে বন বিভাগের কাছে আবেদন করতে বলা হয়েছে। নিহত প্রতিটি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে সারা বছর ঘুরে বেড়ায়। সীমান্তবর্তী সব এলাকায় হাতি প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবক দল রয়েছে। তাঁদের হ্যান্ড মাইক, টর্চ দেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। হাতি এলাকায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা মাইকে গ্রামবাসীকে বিষয়টি জানান। এ ছাড়া কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে।