এক উৎসবে বদলে যাওয়া ‘তুরি’দের গ্রাম মাধাইপুর

৪০ বছর পর গত বছর করম উৎসব উদ্‌যাপন করেন গ্রামবাসী। এরপর থেকে সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির নতুন ইতিহাস।

‘এক করমই এক কেইরেহ্ হামর ছোটকা গাঁওকর আবদিনকে (অর্থাৎ এক করম উৎসবই এক করে দিয়েছে আমার ছোট্ট গ্রামের মানুষদের)।’ উচ্ছ্বসিত হয়ে মাতৃভাষায় কথাগুলো বলছিলেন গ্রামের মোড়ল নিরঞ্জন তিরকি।

চারদিকে ঢেউখেলানো বরেন্দ্রভূমির মধ্যে ছোট্ট গ্রামটির নাম মাধাইপুর। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার পার্বতীপুর ইউনিয়নে এর অবস্থান। বহু পুরোনো এই গ্রামে আগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ‘তুরি’ সম্প্রদায়ের অনেক পরিবারের বসবাস ছিল। দেশত্যাগের কারণে সেখানে এখন ২৬টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ২৪টি কৃষক পরিবারই ভূমিহীন। বাকি দুই পরিবারের জমির পরিমাণও কম।

দীর্ঘ ৪০ বছর পর গত বছর ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এ গ্রামের সবাই মিলে করম উৎসব (করমগাছের ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে সামাজিক উৎসব) উদ্‌যাপন করেন। এরপর থেকে গ্রামের মানুষের মধ্যকার বিভেদ দূর হতে থাকে। সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির নতুন ইতিহাস। এসব পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রাখেন গ্রামের অদম্য মেধাবী কাজল পাঁড়ে।

পেটের দায়ে খেতে কাজ করতে হয় গ্রামের কিশোরীদের। তাঁদের বেণি দুলিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার দৃশ্য মনে আনন্দ দেয়। কিন্তু লেখাপড়া থেকে তাঁদের ঝরে পড়তে দেখে মন খারাপ হয় কাজল পাঁড়ের। তুরিদের মধ্যেই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী কাজল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। নিজ মনবেদনার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেন তিনি। তুরিদের কষ্ট–বঞ্চনার কথাও উঠে আসে তাঁর লেখায়।

গত বছর ৯ আগস্ট ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তুরি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে আরও উৎসাহিত হন কাজল। চার দশক পর গত বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ও টাকা তুলে আয়োজন করা হয় করম উৎসবের।

কাজল পাঁড়ে বলেন, করম উৎসবের পর থেকেই গ্রামে সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির নতুন ইতিহাস। পাশাপাশি ঘরে বাস করা যেসব পরিবারের মধ্যে বিভেদ ছিল, তা দূর হয়েছে। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলো, পৈতৃক সম্পত্তিতে এখন নারীদেরও ভাগ দেওয়া হচ্ছে। মাসখানেক আগে প্রথমবারের মতো গ্রামের পাঁচ নারী জমির মালিকানা পেয়েছেন। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো এক বছরে কোনো ছাত্রী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েনি।

কাজল পাঁড়ে বলেন, ‘একটি সামাজিক উৎসবের যে এত ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তা কল্পনা করতে পারিনি। এসব আয়োজনের পেছনে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে প্রথম আলোর প্রতিবেদন। প্রথম আলোর স্লোগানের মতো “ভালোর সাথে আলোর পথে” হাঁটতে শুরু করেছে মাধাইপুরের মানুষ।’

৬ আগস্ট দুপুরে গিয়ে কথা হয় গ্রামের মোড়ল নিরঞ্জন তিরকির সঙ্গে। এক বছরে গ্রামের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো ও এর পেছনে কাজল পাঁড়ের ভূমিকার কথা জানান তিনি।

গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খেতে অন্য নারীদের সঙ্গে আমন ধান বুনে চলেছে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা। মালকোঁচা মেরে ধান বুনছেন কাজলও। গা থেকে ঝরছে ঘাম। একই খেতে ধান বুনছিলেন দশম শ্রেণিপড়ুয়া মায়া তিরকি, সপ্তম শ্রেণির মোহনা জেড়ি ও অন্য দুজন নারী। মায়া ও মোহনা বলে, ‘যত কষ্টই হোক, হামরা আর লেখাপড়া থাকি ঝরে পড়তে চাহি না।’