নেত্রকোনায় বিজয়া দশমীর দিন দম্পতি হত্যা, ৮ বছর পরও রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়নি

নিহত অরুণ কুমার সাহা ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী সাহা
ছবি: সংগৃহীত

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলায় শোবারঘরে বিজয়া দশমীর দিন এক দম্পতিকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার আট বছর পরও হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মামলাটি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ছয়বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জোড়া খুনের বিচার নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন পরিবারের সদস্যেরা।

পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার শেষ দিন (বিজয়া দশমী) ভোর থেকে বেলা একটার মধ্যে নিজ বাড়ির তিনতলার শোবারকক্ষে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী অরুণ কুমার সাহা (৭৪) ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী সাহা (৬৫)। অরুণ কুমার সাহা দুর্গাপুর পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকায় ‘সুবর্ণা প্লাজা’ নামের তিনতলা মার্কেট এবং সেখানকার সুবর্ণা বস্ত্রালয়ের মালিক ছিলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা প্লাজার তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট ছেলে সুদীপ কুমার সাহা এবং মেয়ে সুলেখা সাহা থাকেন ইতালিতে। বড় মেয়ে সুবর্ণা সাহা কানাডায় থাকেন। বড় ছেলে সুজিত কুমার সাহা মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। সুজিতের স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। অরুণ কুমার ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী নিহত হওয়ার আগের দিন সুজিত কুমার মা-বাবাকে বাসায় রেখে পারিবারিক কাজে ঢাকায় যান। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর মা-বাবার খোঁজ নিতে মুঠোফোনে কথা বলতে চান। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দুপুরের দিকে পাশের বাসার কাকা অজিত কুমারকে ফোন করে তাঁর বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে বলেন। পরে অজিতের স্ত্রী সুচিত্রা তৃতীয় তলায় অরুণের বাসার দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢোকেন এবং পৃথক দুটি কক্ষের মেঝেতে গলাকাটা ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় অরুণ ও হেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল গিয়ে লাশ দুটি উদ্ধার করে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী বিক্ষোভ, মানববন্ধন, হরতাল ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি পালন করেন। হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর ২৬ অক্টোবর তাঁদের বড় ছেলে সুজিত কুমার সাহা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে দুর্গাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। দুর্গাপুর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল ইসলাম খান বর্তমানে আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিএন) কর্মরত রয়েছেন।

স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডাকাতির সময় ওই দম্পতি খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। তৎকালীন ওসি রেজাউল ইসলাম খুনের ঘটনাস্থল সংরক্ষণ ও আলামত সংগ্রহ করেননি।

এ বিষয়ে আজ বুধবার সকালে রেজাউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে ওই ঘটনার সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এ ঘটনায় পুলিশ হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। পরে সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দুর্গাপুর থানা-পুলিশের কাছ থেকে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দেওয়া হয়। সিআইডি তদন্ত নেওয়ার পর তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। সিআইডির সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা নেত্রকোনা সিআইডিতে দায়িত্বে থাকা তখনকার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার শংকর কুমার দাস। তিনি ২০১৭ সালের শেষ দিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে। পরবর্তী সময়ে মামলার বাদী চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে মামলাটি আবার তদন্তের জন্য ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন। ওই কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. আবুল কাশেম তা তদন্ত করেন। এরপর ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর পিবিআই নেত্রকোনা কার্যালয় স্থাপিত হলে একই বছরের ১১ অক্টোবর মামলাটির দায়িত্ব পান কার্যালয়টির পরিদর্শক মোহাম্মদ জাকির হোসেন।

সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তা শংকর কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এই জোড়া খুনের তদন্তভার এক বছর চলে যাওয়ার পর আমাকে দেওয়া হয়েছিল। অনেক দিন চলে যাওয়ায় খুনের বেশির ভাগ আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। সন্দেহে থাকা কয়েকজনের ব্যবহৃত মুঠোফোনের কল রেকর্ডও পাওয়া যায়নি।’

মামলার বর্তমান অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রাইম সিনসহ খুনের প্রয়োজনীয় আলামত তখন সংরক্ষণ না করায় মামলাটি নিয়ে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। তবে ডাকাতিসহ সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চালানো হচ্ছে।’

নিহত দম্পতির বড় ছেলে সুজিত কুমার সাহা বলেন, ‘এ পর্যন্ত ছয়বার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা শুধু বলেন, আরও সময় লাগবে। বিষয়টি নিয়ে এখন হতাশ হচ্ছি। মা–বাবাকে তো আর কখনো পাব না। কিন্তু আমি চাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটিত হোক।’

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের সঙ্গে কথা বলা হবে।