ডিসি–এসপির উপস্থিতিতে হামলার অভিযোগ শিক্ষার্থীদের, প্রশাসন বলছে ‘ধাক্কাধাক্কি’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ সকালে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরাছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় পুরো ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও বিএনপির এক নেতার উপস্থিতিতেই এ হামলা হয়, কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতদের হামলার সময় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রক্টরিয়াল বডিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হামলার পর সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ টহল দিলেও সোমবার সকালেই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং সকাল ৯টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়েননি, বরং বিক্ষোভ মিছিল করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আটকে থাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসার সময় কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন।

আজ সোমবার সাকলে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানান, উপাচার্যের বাসভবনের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে কিছু বহিরাগত সন্ধ্যার পর থেকে অবস্থান করছিলেন। ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ আমজাদ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসক ও এসপির উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথার বলার সময় উপাচার্যের বাসভবনের পাশ থেকে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে একটি দল।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতা শেখ আমজাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক বারবার ফোন করে আমাকে সেখানে নিয়ে যান, আমি সেখানে যেতে চাইনি। আমি সেখানে একা যাই, আমার সঙ্গে কোনো হামলাকারী ছিল না। শিক্ষকেরা আটক ছিলেন। মানবিক দিক বিবেচনায় সেখানে যাই।’

আরও পড়ুন

আন্দোলনত শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ করে বহিরাগতরা অতর্কিত হামলা করে। কাদের নির্দেশে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে এসে হামলা করেছে, তাদের শনাক্ত ও হামলাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হোক।’

শিক্ষার্থী ফাহাদ আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রশাসন বহিরাগত কিছু লোক ভাড়া করে হামলা চালায়, এটি খুব লজ্জাজনক। প্রশাসনকে এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আল শাহরিয়ার বলেন, ‘হামলা করেছে মূলত স্যারদের মদদে। যারা আশপাশের এলাকাতেই ছিল। উপস্থিত জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ছাত্রদের রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন না করলেও আন্দোলন শেষে যখন আমার হলে ফিরে যাই, তখন র‌্যাব ও পুলিশের টহল গাড়ি দিয়ে ভয় দেখানো ও হল ছাড়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়।’

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তাহসিনা আবরার বলেন, ‘যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে আক্রমণ করানো হয়েছে। পুরো প্রক্টরিয়াল বডি যারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ চাই। হামলার বিচার চাই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশ
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবি মেনে নেওয়া হয়। এ ছাড়া চলমান দুটি পশু পালন ও ভেটেরিনারি ডিগ্রিও চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। ওই দুটি ডিগ্রি আমরা চাইলেই বাতিল করতে পারি না। এগুলো সরকার থেকে অনুমোদন করা। আমরা চেয়েছিলাম অল্প কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে দুটি ডিগ্রি চালু থাকুক। শিক্ষার্থীরা তা চাচ্ছিলেন না, এ নিয়ে দ্বিমত সৃষ্টি হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. আবদুল আলীম আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত খুলে দেওয়া হবে। বহিরাগতদের হামলার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদের শনাক্ত ও এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে।’

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুফিদুল আলম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ও প্রক্টরের পক্ষ থেকে তাঁদের উদ্ধারের জন্য অনুরোধে আমরা সেখানে যাই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ করে একজন শিক্ষক অচেতন হয়ে গেলে তাঁকে বের করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলাম। এ সময় একটি দল মিছিল নিয়ে ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে বলে আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাচাই–বাছাই করে দেখবে তারা (হামলাকারীরা) কারা।’

আরও পড়ুন

হামলাকারীদের ঠেকাতে পুলিশ পদক্ষেপ নেয়নি কেন, এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, ‘ওই সময় আমি ও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ সদস্য সেখানে ছিলাম, তবে সবাই নিরস্ত্র। ছাত্ররা পুলিশ দেখে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল, যে কারণে পুলিশ ফোর্স জব্বারের মোড়ে রাখা হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আমরা সেখানে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) অন্যদিকে চলে যায়। ওই সময় আমরা নিরস্ত্র ও লাঠিসোঁটা না থাকায় পরিস্থিতি সামলাতে পারিনি। যারা হামলা করেছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গতকাল রোববার হামলার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

প্রশাসন বলছে ‘ধাক্কাধাক্কি’

গতকালের ঘটনার বিষয়ে আজ সোমবার বিকেলে নিজেদের ভাষ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. হেলাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত ভাষ্যে বলা হয়, গতকাল একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রথমে শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট ছিল। তবে ‘কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে’ পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। শিক্ষার্থীরা প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তাকে মিলনায়তনে তালাবদ্ধ করে রাখে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বয়োবৃদ্ধ, হৃদ্‌রোগী, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও অন্তসত্ত্বা শিক্ষক। দুপুরের গরমে ও অভুক্ত অবস্থায় দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থেকেও শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালান। জেলা প্রশাসক ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ব্যর্থ হন। কয়েকজন নারী শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁদের বের হতে দেওয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরও বলছে, বিকেলের দিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে মিলনায়তনের দক্ষিণ ও মুক্তমঞ্চের দিকের তালা কে বা কারা ভেঙে দেয়। আটকে থাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসার সময় কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছে।

প্রশাসনের ভাষ্যে উল্লেখ করা হয়, ‘অবরুদ্ধ অবস্থার’ সমাপ্তির পর একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালিয়েছে আন্দোলনকারীরা, যা দাবির বাইরে গিয়ে ‘গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ’। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ক্ষুণ্নকারী বা হামলাকারী যেই হোক, তদন্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন