রাত হলেই হেমন্তের বাতাস ভরে ওঠে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে
বেশ রাত হয়ে গেছে। বাসায় ফিরছেন একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা হাসান তারেক। মৌলভীবাজার শহরের শমসেরনগর সড়ক তখন কিছুটা নির্জন হয়ে আসছে। যানবাহনের চলাচলও অনেকটা কমে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই তিনি বলে উঠলেন, ‘বাতাসে কিসের যেন গন্ধ আসছে!’ বেশ ঝাঁজালো গন্ধটি যদিও অনেকেরই চেনা, বাংলার চিরকালের প্রকৃতিতে এ রকম করেই সবাইকে জানিয়ে সে বছর বছর ফিরে আসে। তখনই মনে হয়, কার্তিক এসেছে দেশে। প্রকৃতিতে চলে এসেছে হেমন্তকাল।
ছাতিম ফুল শহরে এখন অনেকটা অপ্রতুল হলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। হঠাৎ কোনো সড়কের পাশে, ঝোপঝাড়ের ভেতর, নয়তো কোনো বাসাবাড়ির গাছপালার ভেতর একটি-দুটি গাছের দেখা মিলছে। শহরের বাইরেও যে খুব বেশি দেখা যায়, তা না। তবু গ্রামের পথে যেতে যেতে কোথাও না কোথাও দু-একটি গাছের দেখা তো পাওয়াই যায়। মনে হয়, মাথা ভর্তি মৃদু ঘিয়ে, সবুজ-সাদা রঙের ঝোপালো আলো হয়ে ফুটে আছে এসবছাতিম গাছ, ছাতিমের ফুল।
এক দুপুরে মৌলভীবাজারের দেওরাছড়া চা-বাগানে একটি ছাতিমগাছের দেখা মেলে। গাছটি যেন হেমন্ত এসেছে, কথাটা জানিয়ে দিতে আরও উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চা-বাগানের কারখানার কাছে একটি টিনের চালার ঘরের পাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো গাছটির কোনো তাড়া নেই। তার পেছনে যেন ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে...।’ সেদিনটাও ছিল রোদঝলমলে। শুধু হালকা সাদা রঙের পাতলা কিছু মেঘ নীল রঙের আকাশে মিশে আছে, বাকিটা কেবলই নীল। ছাতিমগাছটির শরীরভরা থোকা থোকা ফুল। ধাপে ধাপে, থোকায় থোকায় কেউ যেন ফুলগুলোকে সাজিয়ে রেখেছে!
ছাতিমগাছের ফুলগুলো রোদে হাসছে, রোদে ভাসছে। ফুলের প্লাবনে পাতারা আড়ালে হারিয়ে গেছে। গাছের নিচে ঘাসের ওপর, বুনো গাছের পাতার ওপর ঝরে পড়েছে ছাতিম ফুলের অসংখ্য পাপড়ি। সবুজের মধ্যে যেন হালকা সাদা, হালকা ঘিয়ে রঙের ফোঁটা কেউ সুই-সুতোয় সেলাই করে রেখেছে। এই সময়ে প্রকৃতিতে অন্য জাতের ফুলের দেখা খুব বেশি পাওয়া যায় না। ছাতিম তখন অনেকটা একলা আসে, একলা হাসে, একলা ভাসে—প্রকৃতিতে একলা ফুলকুমারী সে। দিনের বেলা ব্যস্ত সময়ে হয়তো কারও চোখে এই গাছ, এই ফুল না–ও পড়তে পারে। রাত হলে ঠিকই সে জানিয়ে দেয়, সে আছে পাশাপাশি কোথাও।
নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে এই ছাতিম সম্পর্কে বলেছেন, ছাতিমের কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে। এমন ছাতিম দুর্লভ না, যার ডালপালা ছড়ানোর ভঙ্গিটি বিশেষ কয়েকটি জোড়া দেওয়া ছাতার মতো দেখায়। সরল উন্নত কাণ্ড কিছুদূর ওপরে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি ঢাকনা সৃষ্টি করে আবার একলাফে একে ছাড়িয়ে অনেক দূর ওঠে যায়। ছাতিম পাতার বোঁটা ছোট, ফলক দীর্ঘ-বর্শাফলাকৃতি কিংবা দীর্ঘ-ডিম্বাকৃতি, কিনার অখণ্ড। ছাতিমের ছাল স্থূল, শ্বেতকষপূর্ণ, অমসৃণ ও ধোঁয়াটে সাদা। ছাতিমগাছ চিরহরিৎ।
ছাতিম ফুলের গন্ধে নেশার ঝাঁজ আছে। এমন প্রখরভাবে নিজেকে ঘোষণার সামর্থ্য খুব কম গাছেরই আছে। ছাতিম ফুলের নিচের অংশ নলাকৃতি এবং নল-মুখের পাঁচটি পাপড়ি ঈষৎ বাঁকানো। ছাতিমের ফল সরু লম্বা এবং ফুলের মতোই অজস্র সংখ্যায় সারা গাছে ছড়িয়ে থাকে। বসন্তের শেষ ফল পাকার সময়। কাঠ তেমন সরেস না হলেও দরজা, জানালা, ছাদ ও সাধারণ আসবাবে ব্যবহার করা যায়। এর ভেষজমূল্যও আছে। ছাল ও আঠা জ্বর, হৃদ্রোগ, হাঁপানি, ক্ষত, আমাশয় ও কুষ্ঠে উপকারী। ছাতিমের আদি নিবাস চীন, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়া।