প্রকাশ্য দুপুরে যশোর জেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বদিউজ্জামানকে (৫২) এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যান চার খুনি। বদিউজ্জামান চিৎকার দিয়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাঁর স্ত্রী শারমিন আকতার চিৎকার শুনে বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে ঘটনাস্থলে এলে খুনিরা দ্রুত পালিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি প্রাণ হারান।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, নিহতের স্ত্রী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র তিন মিনিটে হত্যার মিশন সফল করেন খুনিরা। মিশনের নেতৃত্ব দেন যশোর কোতোয়ালি থানার চার মামলার আসামি মো. রায়হান (৩০)। তিনি যশোর শহরের রেল সড়কের ফরিদ হোসেনের ছেলে। দলীয় পরিচয় না থাকলেও তিনি তাঁর মামা যশোর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শামীম আহম্মেদের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে থাকেন।
আজ বুধবার বেলা ১১টায় জানাজা শেষে বেজপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বদিউজ্জামানকে। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেন। এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির নেতারাও অংশ নেন।
বদিউজ্জামানের বাড়ি যশোর শহরের বেজপাড়া আকবারের মোড়ে। তাঁর দুই ছেলে–মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে এবং ছেলে যশোর জিলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আজ দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মায়ের কোলে বসে তারা বাবার শোকে মুহ্যমান। সন্তানদের জড়িয়ে ধরে তাদের মা শারমিন আকতার কেঁদেই যাচ্ছেন।
কাঙ্ক্ষিত পদপদবি না পাওয়ায় শামীম আহম্মেদের সঙ্গে বদিউজ্জামানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পরে প্রকাশ্য বিরোধ হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বদিউজ্জামান নিজের বাড়ির সামনে দোকানে বসে ছিলেন। এ সময়ে কয়েকজন সন্ত্রাসী অতর্কিত সেখানে উপস্থিত হয়ে রামদাসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে বদিউজ্জামানকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। বদিউজ্জামানের চিৎকার শুনে বাড়ির ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রীকে দেখে সন্ত্রাসীরা দ্রুত সটকে পড়েন। রক্তাক্ত অবস্থায় ইজিবাইকে করে তাঁকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বদিউজ্জামানের স্ত্রী শারমিন আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বদিউজ্জামান কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি বাড়ির সামনে একটি ওষুধের দোকানে বসে ছিলেন। এ সময় কয়েকজন সেখানে গিয়ে তাঁকে কোপাতে শুরু করে। আমি তখন রান্না করছিলাম। তাঁর চিৎকার শুনে দ্রুত বাইরে গিয়ে দেখি, রায়হানসহ কয়েকজন তাকে কোপাচ্ছে। রায়হানকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্যদের মুখে মাস্ক পরা ছিল। রায়হান হচ্ছে স্থানীয় শামীম আহম্মেদের ভাগনে।’
শারমিন আকতারের বর্ণনার সত্যতা মিলল বাজারের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে। ওই ফুটেজে সরাসরি কোপানোর দৃশ্য দেখা না গেলেও ঘটনাস্থলে মো. রায়হানকে আসতে ও বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখছেন।
ওই সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করা ও আসামিদের আটকে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) বেলাল হোসেন বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই–বাছাই ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে হত্যা মিশনে সরাসরি চারজন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে রায়হান ও তাঁর সহযোগী মন্টু (২০) নামের দুজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তাঁদের আটক গ্রেপ্তার করা যায়নি। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড—এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসেন বলেন, স্থানীয় শামীম আহম্মেদ ও বদিউজ্জামানের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল। ওই দ্বন্দ্বের জেরে শামীম আহম্মেদের মেয়ের জামাই ইয়াসিন হত্যা মামলায় বদিউজ্জামানকে আসামি করা হয়। রায়হান তাঁর মামা শামীমের স্বার্থ রক্ষায় বদিউজ্জামানকে খুন করতে পারেন।
পুলিশ জানায়, রায়হানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও মায়ের সম্পর্ক ভালো নয়। তাঁর স্ত্রীর দাবি, রায়হান আরেকটি বিয়ে করেছেন। এ জন্য বাড়িতে তিনি কম আসেন। তবে রায়হানকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেন তাঁর মামা শামীম আহম্মেদ। শামীমের প্রয়োজনে রায়হান ব্যবহৃত হন।
শামীমের সঙ্গে দ্বন্দ্বই মূল কারণ
শামীম আহম্মেদের সঙ্গে নিহত বদিউজ্জামান ও তাঁর পরিবারের স্বজনদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। বাদিউজ্জামান জেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির পদ পেলেও শামীম আহম্মেদ পান যশোর পৌরসভার ৭ নম্বর (শংকরপুর) ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতির পদ। পরে অবশ্য তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পৌর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হয়েছেন। কাঙ্ক্ষিত পদপদবি না পাওয়ায় শামীম আহম্মেদের সঙ্গে বদিউজ্জামানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পরে প্রকাশ্য বিরোধ হয়। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ মাস আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শামীম আহম্মেদের মেয়ের জামাই ইয়াসিন আরাফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
ওই ঘটনায় শামীম আহম্মেদের মেয়ে শাহানা আকতার নয়জনের নামে মামলা করেন। ওই মামলায় বদিউজ্জামানকে ৮ নম্বর আসামি করা হয়। যদিও ওই মামলার এজাহারভুক্ত চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু চারজনের কেউ হত্যাকাণ্ডে বদিউজ্জামানের জড়িত থাকার কথা বলেননি। যে কারণে বদিউজ্জামানের পরিবারের লোকজনের দাবি, শামীম আহম্মেদ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বদিউজ্জামানকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ওই হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে বদিউজ্জামানের বড় ভাই মনিরুজ্জামান বলেন, ‘শামীম আহম্মেদ আর বদিউজ্জামান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক পদপদবি না পেয়ে শামীম আহম্মেদ আমার ভাইকে ঈর্ষা করতেন। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্যে ইয়াসিন হত্যা মামলায় পরিকল্পিতভাবে শামীম আমার ভাই বদিউজ্জামানকে ফাঁসিয়ে দেন। বদিউজ্জামান ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। তারপরও তাঁদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। রায়হানকে দিয়ে আমার ভাইকে হত্যা করিয়েছেন শামীম।’