দিব্য স্তম্ভ, ভিমের পান্টির নাম কি শুনেছেন

নওগাঁর মান্দায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদছবি: প্রথম আলো

বাংলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাকীর্তিগুলো আজও সভ্যতা আর সংস্কৃতির বিচরণভূমি। প্রাচীন সভ্যতা আর সংস্কৃতির তেমন এক বিচরণভূমি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ নওগাঁ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে নওগাঁ জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রাচীন স্থাপনা ঘুরে দেখা ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে।

প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ এই জনপদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাজার বছর আগের মহাবিহারের (প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়) ধ্বংসস্তূপ। এ ছাড়া এখানে দেখা মিলবে বাংলায় কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক দিব্য স্তম্ভ, গরুড় স্তম্ভ (ভিমের পান্টি), যাতে একখানি প্রস্তরখণ্ডে হাজার বছর আগে খোদাই করা রয়েছে বাংলার ইতিহাসের কিছু অংশ। দেখা মিলবে মোগল আমলের দুর্গ শহর খ্যাত মাহীসন্তোষ। আরও আছে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ। এর বাইরেও প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা সাক্ষ্য বহন করে চলেছে নাথ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান প্রাচীন স্থাপনা যোগীঘোপা। এ ছাড়া এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো দর্শনীয় সব স্থান। নওগাঁয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সব প্রাচীন পুরাকীর্তি, প্রাচীন মসজিদ, রাজবাড়িসহ নানান ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একজন দর্শনার্থীর প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যাবে। 

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার 

ইউনেসকো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। এটার প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার। এটি বাংলাদেশসহ নওগাঁ জেলার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বহন করে। জায়গাটি নওগাঁ সদর থেকে ৩৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে বদলগাছি উপজেলায় পড়েছে। আবার জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে এই বিহার। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই প্রাচীন বৌদ্ধবিহার কালের বিবর্তনে জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯২৩ সালে এর উৎখনন শুরু হয়, ১৯৩৪ সালে শেষ হয়। 

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাল বংশের শাসনামলে দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকে পিতৃভূমি বরেন্দ্রে এক বিশাল বৌদ্ধমন্দির স্থাপনের লক্ষ্যে পাহাড়পুরে সোমপুর বিহার স্থাপন করেন। খননকালে প্রাপ্ত একটি মাটির সিল থেকে জানা যায়, এটি সোমপুর বিহার। ২৭ একর জমির ওপর এটি স্থাপিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম বিহার। এর চারদিকে সারিবদ্ধভাবে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে। 

সমগ্র বিহার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। উত্তর দিকে প্রবেশপথ ছিল। মূল দালানে ওঠার সিঁড়িও ছিল। এটি দুর্গের মতো করে তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রধান মন্দিরের ভিত্তিমূল–সংলগ্ন দেয়ালে ৩৬টি পাথরের মূর্তি রয়েছে। ভেতরের মন্দিরের গায়ে ২ হাজার পোড়ামাটির চিত্রফলক রয়েছে। খননকালে প্রায় ৮০০ পোড়ামাটির চিত্রফলক বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। 

এই বিহার জ্ঞান-বিজ্ঞান, মীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য একটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদমর্যাদা লাভ করেছিল। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান লাভের জন্য আসতেন। আচার্য অতীশ দীপঙ্কর সোমপুর বিহারে কিছুকাল বাস করেছেন। তাঁর গুরু রত্নাকরশান্তি সোমপুর বিহারের মহাস্থবির ছিলেন। এখানে আরও অবস্থান করতেন প্রাচীন চর্যাপদের গীতিকার কাহ্নপা ও তাঁর গুরু জলন্ধরী পা ওরফে হাড়ী পা। এখানকার উদ্ধারকৃত প্রত্নবস্তু নিয়ে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। অতিথিদের থাকার জন্য বাংলো রয়েছে।

হলুদ বিহার 

পাহাড়পুরের ঠিক এক কিলোমিটার আগে পড়বে আরেকটি বিহার। এটি বদলগাছি উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নের দ্বীপগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত। এটি পাহাড়পুরের সমসাময়িক একটি বৌদ্ধবিহার। এটিও অন্তত হাজার বছরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান হলুদ বিহার তথা দ্বীপগঞ্জ গ্রাম পুরোটাই প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষের ওপর অবস্থিত বলে অনুমান করা যায়। এই গ্রামের সবখানেই প্রাচীন ইট, নকশা করা ইট, পোড়া মাটির চিত্রফলকের টুকরা, কোনো কোনো স্থানে প্রাচীন দালানের ভিত্তি চিহ্ন চোখে পড়বে।

বটগোহালী বিহার 

পাহাড়পুর বিহার থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর–পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন গ্রাম আছে। নাম বটগোহালী। এখানে একটি প্রাচীন জৈন বিহার ছিল। পাহাড়পুর বিহার খননকালে একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এই লিপি থেকে জানা যায়, এক ব্রাহ্মণ দম্পতি কর্তৃক বটগোহালীতে অবস্থিত একটি জৈন বিহারের ‘অইত’ পূজা ও একটি বিশ্রামাগারের জন্য কিছু রাষ্ট্রীয় ভূমি ক্রয় ও দান করা হয়েছিল। এই জৈন বিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈন গুরু গুহ নন্দী এবং তাঁর বহু শিষ্য-প্রশিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জৈন বিহারটি যে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল, পাণ্ডুলিপিটি তা প্রমাণ করে।

জগদ্দল বিহার

পাহাড়পুর বিহার থেকে আরও ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ধামইরহাট উপজেলা। এই উপজেলায় আরও কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জগদ্দল বিহার। এটি ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিহার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের সমসাময়িক সময়ে নির্মিত। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের রচয়িতা আবুল ফজল এ স্থানকে রমৌতি বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা রামপাল গৌড় রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর রমাবতী নগরে জগদ্দল মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিহারে মূল মন্দির ছাড়াও ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ৫০টি কক্ষ রয়েছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতোই এই বিহারও প্রাচীন বাংলার শিক্ষাদীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। ১৯৯৬ সালের পর তিনবার এই বিহারে উৎখননের কাজ হয়। বর্তমানে এখানে চতুর্থ পর্যায়ের উৎখননকাজ চলছে।

 অগ্রপুরী বিহার 

ধামইরহাট থানা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে কাশিপুর মৌজায় আগ্রাদ্বিগুন বাজারের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের মতো উঁচু বিরাট ঢিবি রয়েছে। এর ওপরের অংশ প্রায় সমতল। তিব্বতীয় সাহিত্যে এটাকে অগ্রপুরী বিহার বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে নির্মিত এককালে এটি বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এখানকার চার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অসংখ্য প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। এলাকাজুড়ে অসংখ্য প্রাচীন জলাশয়েরও অস্তিত্ব দেখা যায়। এটি এখনো পুরোপুরি খনন সম্পন্ন হয়নি। এর ইতিহাস এখনো অজানা।

ভিমের পান্টি বা গরুড় স্তম্ভ

ধামইরহাট থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মঙ্গলবাড়ি। এখানে রয়েছে ভিমের পান্টি (স্থানীয় জনপ্রবাদ মতে)। আসলে এটি গরুড় স্তম্ভ। একখণ্ড পাথরের স্তম্ভে শিলালেখ রয়েছে। এর শীর্ষদেশে একটি গরুড় মূর্তি ছিল। বজ্রপাতে মূর্তিসহ ওপরের অংশটি ভেঙে গেছে। স্তম্ভটি একটু হেলে গেছে। এই স্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় ২৮ লাইনের একটি লিপি খোদাই করা আছে। স্তম্ভটি নিয়ে কিংবদন্তি হচ্ছে, মহাভারত–খ্যাত ভীম রাতে হালচাষ করতেন। সকাল হওয়ার আগেই তাঁর ফিরে যাওয়ার নিয়ম ছিল। এক রাতে বিলম্ব হওয়ায় তাড়াহুড়া করে যাওয়ার সময় হাতের পান্টিটি ফেলে যান।

তবে ঐতিহাসিকেরা স্তম্ভটির পাঠোদ্ধার করেছেন। এ থেকে জানা যায়, নবম-দশম শতকে পাল রাজা নারায়ণ পালের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী মিশ্র বংশীয় ভট্টগুরব মিশ্র বিষ্ণুর উদ্দেশে এই স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লিপিতে মিশ্র বংশের বিশদ পরিচয় ও তাঁদের সঙ্গে পাল রাজাদের সম্পর্কের কথা উল্লেখ আছে।

নাথ সম্প্রদায়ের স্থাপনা 

ধামইরহাট থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে পত্নীতলা উপজেলায় বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান রয়েছে। পত্নীতলা উপজেলার আমইর ইউনিয়নে প্রাচীন ইছামতী নদীর পশ্চিম পাশে যোগীঘোপা বা যোগীগোফা নামক স্থানে এই তীর্থস্থান। এখানে নাথ সম্প্রদায়ের কিছু প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই জায়গার কাছেই আমইর নামক স্থানে পাল রাজা রামপাল প্রতিষ্ঠিত রামাবতী নগরী ছিল।

নওগাঁর আরও কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন

প্রাচীন সব পুরাকীর্তি ছাড়াও শানশওকত আর চাকচিক্যের সাক্ষ্য হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে দিবর দিঘি, প্রাচীন শহর মাহীসন্তোষ, কুসুম্বা মসজিদ, নওগাঁর গাঁজা মহল, বলিহার রাজবাড়ি, দুবলহাটি রাজবাড়ি ও পতিসরে রবীন্দ্র কাছাড়িবাড়ি। 

প্রাচীন পুরাকীর্তি ও অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নানান স্থাপনা ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা এই জেলা।


ক্রোড়পত্র সম্পাদক: তুহিন সাইফুল্লাহ● সহযোগী: দেলোয়ার হোসেন● গ্রাফিকস: মাইদুল ইসলাম