ধুঁকে ধুঁকে চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঠাগারটি 

পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক বেতন পাচ্ছেন না গত ২০ মাস। পত্রিকার বিল বাকি ১১ মাসের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারে বই রয়েছে ২৫ হাজার। তবে বর্তমানে পাঠক তেমন আসেন না। গত রোববার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পাঠাগারটির বয়স প্রায় ৬৫ বছর। এটি ছিল বইপ্রেমীদের প্রিয় স্থান। আয়োজন করা হতো বিভিন্ন পাঠচক্রের। কিন্তু সেসব দিন যেন এখন দূর অতীতের কথা। বর্তমানে পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। পাঠাগারটি চলছে ধুঁকে ধুঁকে। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারের চিত্র। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। এটি ছিল শহরের ঐতিহ্য ও সুনামের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক বেতন পাচ্ছেন না গত ২০ মাস। হকারের কাছে পত্রিকার বিল বাকি পড়েছে ১১ মাসের। বেতনের অভাবে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন পাঠাগারের অফিস সহায়ক। দুই মেয়াদ পার হলেও নেই নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের স্কুল-কলেজ সড়কে দোতলা ভবনে চলে পাঠাগারের কার্যক্রম। নিচতলায় পত্রিকা পড়ার কক্ষ। দোতলায় বই পড়ার কক্ষ। পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা ২৫ হাজার। রোববার ছাড়া সপ্তাহের ৬ দিন পাঠাগার খোলা থাকে; বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। পাঠাগারের আজীবন সদস্যসংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এককালীন তিন হাজার টাকা দিয়ে আজীবন সদস্য হওয়া যায়। তাঁদের মাসিক চাঁদা দিতে হয় না। আগে ৫০০ টাকা দিয়ে সাধারণ সদস্য হওয়া যেত। তাঁদের মাসিক চাঁদা ছিল ২০ টাকা। করোনার পর থেকে সাধারণ সদস্য বাদ দেওয়া হয়েছে।

পাঠাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক সত্যেন সাহা জানান, নতুন বই কেনা হয়নি ১০-১২ বছর। তবে এ সময়ে অনুদানের বই এসেছে। ৮-১০ বছর ধরে পাঠকের সংখ্যা কমেছে। করোনার পর পাঠকের সংখ্যা একেবারে কমে গেছে। গত জানুয়ারি থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িতে পড়ার জন্য বই নিয়ে গেছেন ১৬ জন পাঠক। প্রতিদিন পত্রিকা পড়তে আসা পাঠকের সংখ্যা ৮-১০। 

সাধারণ পাঠাগারের একসময়ের নিয়মিত পাঠক ছিলেন নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ মাযহারুল ইসলাম। পাঠাগারের দুরবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় বইপড়ুয়া, নাগরিক সমাজের অগ্রসর মানুষেরা পাঠাগার নিয়ে মাথা ঘামাতেন। এখন আর সেটা দেখা যায় না। বই, পত্র-পত্রিকা পড়তে আসা মানুষের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। সেটাও আর দেখা যায় না অনেক বছর থেকে। শুনেছি, অনেকদিন থেকে বেতন পান না গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক। বিষয়টি বড়ই বেদনার।’ 

পাঠাগারে একসময় পাঠচক্র পরিচালনা করতেন শহরের বেলেপুকুর মহল্লার বাসিন্দা হামিদুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলী আশরাফ। তিনি বলেন, ‘ইংরেজি ভাষায় দর্শন ও বিশ্বসাহিত্যের অনেক বই এ পাঠাগারে রয়েছে। এ পাঠাগার থেকে বার্ট্রান্ড রাসেল, জন কিটসের একাধিক বই পড়েছি। তবে বহু বছর থেকে এখানে নতুন বই কেনা হয় না। আগ্রহী পাঠকদের আকর্ষণ করার মতো বই কেনার উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া এখন তরুণসমাজ স্মার্টফোনে আসক্ত থাকায় বই পাঠে তাদের আগ্রহ নেই। পাঠাগারের এই পাঠকশূন্য অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ বের করার উদ্যোগ নিতে হবে সচেতন নাগরিকদের।’ 

সাধারণ পাঠাগারের এ বেহালের দায় পাঠাগারের নির্বাহী কমিটির ওপরই পড়ে বলে মনে করেন নাগরিক কমিটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদস্যসচিব মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, যাঁরা বই ভালোবাসেন, পাঠাগারকে ভালোবাসেন, এমন মানুষদের নিয়েই পাঠাগারের নির্বাহী কমিটি গঠন করা উচিত।

এ সম্পর্কে পাঠাগারের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে ২০১৯-২১ মেয়াদে তেমন কোনো কাজ করা সম্ভব হয়নি। ২০২১-২৩ মেয়াদে সহকর্মীদের সহযোগিতার অভাবে পাঠাগারের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। পদাধিকারবলে এ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন জেলা প্রশাসক। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত একটি সাধারণ সভা ডেকে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেব।’ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান বলেন, পাঠাগারের বেহাল হওয়ার কথাও জানা ছিল না। গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিকের বেতন ও পত্রিকার বকেয়া বিল আংশিকভাবে পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদককে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়েছে।