সংগ্রাম
বিভীষিকা মুছে মর্জিনার ঘুরে দাঁড়ানো
অন্ধকার থেকে শুধু নিজে ফিরে আসেননি, অনেককে দেখিয়েছেন আলোর পথ। যৌনকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে চলেছেনে সংগ্রামী নারী মর্জিনা বেগম। নারী ও শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের জন্য নানা কার্যক্রম চালাচ্ছেন নিজের প্রতিষ্ঠিত মুক্তি মহিলা সমিতির মাধ্যমে। বেসরকারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
যে বয়সটি ছিল ঘুরে বেড়ানো ও আনন্দ করার, মর্জিনা বেগমের সেই বয়স কেটেছে অন্ধকার জগতে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন যৌনপল্লি নামক এলাকার মানুষদের দুঃখ–কষ্ট আর অবহেলা। সেখানকার বাসিন্দাদের প্রতি সমাজের অন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ব্যথিত করত। তখন তিনি শপথ নিয়েছিলেন, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবেন।
সেই সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলেছেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ বাজার আড়তপট্টি এলাকার মেয়ে মর্জিনা বেগম। অন্ধকার থেকে শুধু নিজে ফিরে আসেননি, অনেককে দেখিয়েছেন আলোর পথ। দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে চলেছেনে সংগ্রামী নারী মর্জিনা বেগম। নারী ও শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের জন্য নানা কার্যক্রম চালাচ্ছেন নিজের প্রতিষ্ঠিত মুক্তি মহিলা সমিতির (এমএমএস) মাধ্যমে। বেসরকারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
জীবনের শুরুতে ঝড়
তিন বোনের মধ্যে সবার বড় মর্জিনা বেগম মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান। গোয়ালন্দ ঘাটের মুদিদোকানি নানার কাছে মাসহ তিন বোন থাকতেন। নানার সামান্য আয়ে সংসার চালানো কষ্ট ছিল। ১৩ বছরে তাই কিশোরী মর্জিনাকে ফরিদপুর টেকেরহাটের আসবাবপত্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুর রবের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। আগের সংসারে তিন সন্তান ছিল আবদুর রবের। ব্যবসায়িক কারণে দ্বিতীয় স্ত্রী মর্জিনাকে রাঙামাটি নিয়ে যান আবদুর রব। সেখানে দোকানের কর্মচারীদের জন্য রান্না করতে হতো মর্জিনাকে। প্রায় রাতে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হতেন মর্জিনা। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা মর্জিনা বাড়ি ফিরে আসেন। মর্জিনার ঘরে জন্ম নেয় কন্যাসন্তান। স্বামী ছাড়া মর্জিনার জীবন সংগ্রাম শুরু হয়।
১৯৮০ সালে নানার মৃত্যুর পর নানি, মা আর তিন বোনের দায়িত্ব পড়ে মর্জিনার ওপর। বাজারে পিঠা বিক্রি করে উপার্জন শুরু করেন। কিছুদিন পর প্রতারকের খপ্পরে পড়েন। তাঁকে সিরাজগঞ্জ যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রায় পাঁচ মাস পর ১৯৮৮ সালে চলে আসেন দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে।
মুক্তি মহিলা সমিতি গঠন
১৯৯৫ সালে স্থানীয় বেসরকারি কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থার (কেকেএস) সংগঠক হিসেবে যোগ দেন মর্জিনা। কেকেএস এবং সেভ দ্য চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতায় ২১ জন যৌনকর্মী নিয়ে নেতৃত্ববিষয়ক দল গঠন, অধিকার আদায়, আইনবিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক আলোচনা চালান। সেখান থেকে নারীদের মুক্তির জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৯৮ সালে ১১ জন যৌনকর্মী নিয়ে মর্জিনা বেগম গঠন করেন মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস)। ১৯৯৯ সালে ভারতে যৌনকর্মীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনিসহ পাঁচ সদস্য অংশ নেন। সেখানে দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সমিতি নিবন্ধন লাভ করে। যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে। মুক্তি মহিলা সমিতির মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সময়ে স্যানিটেশন, শিশু শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, এইডস–বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিসহ নানা বিষয়ে কাজ করেন মর্জিনা। ২০০৯ সালে এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন পায় তাঁর সংস্থাটি।
স্বাভাবিক জীবনে মর্জিনা
২০১০ সালে যৌনপল্লি ছেড়ে গোয়ালন্দ বাজার আড়তপট্টির নিজ বাড়িতে ফেরেন মর্জিনা বেগম। তবে নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ অব্যাহত থাকে। ২০১৫ সাল থেকে রস্ক (রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন) প্রকল্পের সঙ্গে নন–স্কুলিং শিশুদের কার্যক্রম পরিচালনা করে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করে মুক্তি মহিলা সমিতি।
সংস্থাটি সচেতনতামূলক নাটক, যৌনকর্মীদের অধিকার, ব্যক্তিগত সঞ্চয়, এইডসের ভয়াবহতা তুলে ধরা, মাদকের বিরুদ্ধে সেমিনার, শিশু শিক্ষায় সবাইকে সচেতন করতে নানা কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে থাকে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস ২০১৫ উপলক্ষে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পান মর্জিনা। পরের বছর ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পান তিনি। ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’ বিভাগে ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা লাভ করেন।
মুক্তি মহিলা সমিতিতে একবেলা
সম্প্রতি মুক্তি মহিলা সমিতির কার্যালয়ে দেখা যায়, পূর্বপাড়ার (যৌনপল্লি) স্থানীয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে দিনব্যাপী চলছে ভিন্নধর্মী আয়োজন ‘মগজধোলাই’। সমিতির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ৮১ জন শিশু দিনব্যাপী গল্পে গল্পে বই পড়া প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, লুডু খেলা, পাজল, ক্লে, ট্রেজার হান্ট ইভেন্টসহ ব্যতিক্রর্মী আয়োজনে অংশ নেয়।
প্রকল্প কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, এখানে ১৬০ জন শিশু রয়েছে। ৫৮ জন যৌনপল্লির এবং ১০২ জন শিশু স্থানীয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় ২০০৪ সাল থেকে শিশুদের খেলার সঙ্গে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি করে স্কুলমুখী করা হয়। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি শিশুকে স্কুলমুখী করা হয়েছে।
পাশের ভবনে দিবাযত্ন কেন্দ্রে আছে ৫০ শিশু। ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থার অর্থায়নে শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের এখানে রাখা হয়। ১০০ শিশুকে প্রাথমিক স্কুলে পাঠানো হয়েছে। পাশের আরেক ভবনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থার অর্থায়নে ২০১৭ সাল থেকে নাইট-কেয়ারে শূন্য থেকে ৬ বছর বয়সী ৪০ জন শিশু রাখা হয়। সন্ধ্যার আগে মায়েরা সন্তানদের দিয়ে পরদিন সকালে নিয়ে যান।
১১ জন যৌনকর্মী নিয়ে মুক্তি মহিলা সমিতি যাত্রা শুরু করলেও আন্দোলন করতে এসে নানা সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে ছেড়ে গেছেন বলে জানালেন মর্জিনা বেগম। বর্তমানে সমিতিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫৬। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায় ২ বছর ধরে ১ হাজার ৭০০ জন নারী ও কন্যাশিশুর মানবাধিকার এবং জেন্ডার–সমতা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। মর্জিনা বেগম বলেন, ইতিমধ্যে ১১৭ নারীকে বিউটি পার্লার, সেলাই প্রশিক্ষণ ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
১০ হাজার টাকা করে দিয়ে আর্থিকভাবে তাঁদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত অন্তত ২৩০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু যৌনকর্মীকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চান তিনি।