জোড়া খুনের পরের দিন দিনাজপুরের গ্রামে আগুনে পুড়ল ২৮ বাড়ি

প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি। আজ দুপুরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার খোদাদাতপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

জোড়া খুনের পরের দিন একটি গ্রামের প্রায় ২৮টি বাড়ি আগুনে পুড়ল। নিহত ব্যক্তিদের পক্ষের লোকজন হামলা চালিয়ে এসব বাড়িঘরে আগুন দেন ও লুটপাট চালান বলে অভিযোগ উঠেছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৪ নম্বর ঘোড়াঘাট ইউনিয়নের খোদাদাতপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

প্রথম আলোর এই সংবাদদাতা বিকেলে গ্রাম ঘুরে ২৮টি বাড়ি আগুনে পোড়ার নমুনা পেয়েছেন। ২৫টি খড়ের গাদাতেও আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে কয়েকটি বাড়ি। কিছু বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে। গরু-ছাগল, টাকাপয়সা ও গয়নাগাটি লুটে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে ফায়ার সার্ভিস দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক মঞ্জিল হক জানিয়েছেন।

প্রতিপক্ষের মানুষের হামলা ও আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর। আজ দুপুরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার খোদাদাতপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। অবশ্য ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু হাসান কবির বলছেন, খোদাদাতপুরের গ্রামের মানুষ চুনিয়াপাড়ার কয়েকটি বাড়িতে ও খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে হাকিমপুর, বিরামপুর ও ফুলবাড়ী থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে রাতে ওই গ্রামে পুলিশি টহল থাকবে বলে ওসি জানিয়েছেন। এদিকে সন্ধ্যায় বিরামপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার এ কে এম ওহিদুন্নবী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

আজ বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামটিতে মূলত দুটি পাড়া। একটি খোদাদাতপুর, অন্যটি চুনিয়াপাড়া। এই পাড়ার মাঝখানে কয়েক বিঘা জমি আছে। চুনিয়াপাড়ায় ৬০টি মুসলিম ও ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিবারের বাস। বছর দুয়েক আগে জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে এসে তাঁরা বসতি গড়েছেন। এঁদের ২৮টি বাড়িতে আজ হামলা চালান খোদাদাতপুর পাড়ার লোকজন।  
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বুধবার সকালে জমি দখলকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় খোদাদাতপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন (২৪) ও রাকিব হোসেন (২৫) নামের দুজন নিহত হন। আজ দুপুরে দুজনের জানাজা চলছিল। এ সময় নিহত ব্যক্তিদের পক্ষের লোকজন চুনিয়াপাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে অগ্নিসংযোগ করেন বলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির লোকজন অভিযোগ করেছেন। অগ্নিসংযোগকালে লোকজন দেশীয় অস্ত্র লাঠি, দা নিয়ে প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালান। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে নারী-শিশু ও পুরুষেরা বাড়িঘর ছেড়ে দৌড়ে পালান।

এ নিয়ে আজ রাত নয়টার দিকে কথা হয় ৪ নম্বর ঘোড়াঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ভুট্টুর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খোদাদাতপুর গ্রামের চুনিয়াপাড়ায় ৬০টি মুসলিম ও ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিবার বসবাস করে। এখানে প্রায় সাড়ে ৩০০ মানুষের বাস। বুধবারের হত্যাকাণ্ডের জের ধরে খোদাদাতপুর গ্রামের মানুষেরা আজ দুপুরে চুনিয়াপাড়ার প্রায় ২৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন।

গ্রামের লোকজন জানান, খোদাদাতপুর গ্রামের হায়দার আলীর সঙ্গে উমর আলীর বাড়ির পাশের ১৬ শতাংশ জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। ওই জমি দুই পক্ষই দাবি করে আসছিল। এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয় এবং ওই জমির ওপরে আদালত ১৪৪ ধারা জারি করেন। গত বুধবার সকালে হায়দার আলীর ছেলে মনোয়ার হোসেন তাঁর বন্ধু রাকিব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ওই জমির পাশে তাঁর নিজের সেচযন্ত্রের ঘরে যান। এ সময় উমর আলীর সঙ্গে মনোয়ার ও রাকিবের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। পরে উমর আলী, তাঁর দুই ছেলে মনিরুল ইসলাম, সামিরুল ইসলাম এবং তাঁর স্ত্রী মোমেদা বেগম বাড়ি থেকে চাকু ও বঁটি এনে মনোয়ার ও রাকিবের ওপর হামলা চালান। এ সময় ঘটনাস্থলেই মনোয়ার মারা যান। গুরুতর আহত রাকিবকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।

এ নিয়ে গতকাল রাতে হায়দার আলী বাদী হয়ে ঘোড়াঘাট থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় ৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে উমর আলী, সামিরুল ইসলাম ও মোমেদা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হাসিনা বেগম জানান, দুপুরে খোদাদাতপুর গ্রামের কয়েক শ মানুষ অস্ত্র নিয়ে এসে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেন এবং বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। তাঁর বাড়ির সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমার, আমার বড় ছেলে শাহজাহান ও ছোট ছেলে রবি আলমের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ওরা। আমার ঘরের চাল, আসবাবপত্র ও বড় ছেলের একমাত্র ভ্যানগাড়িটিও পুড়ে গেছে। আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’