বন্য প্রাণী সংরক্ষণে গবেষণা ও সচেতনতার কাজ করে যেতে চাই

অধ্যাপক মনিরুল খান একজন বন্য প্রাণীবিশেষজ্ঞ। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানের প্রণেতা তিনি। গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ (ইপিএএসআইএই) নামের একটি প্রকল্পে সুন্দরবনের ডলফিন রক্ষা কাজের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনে বাঘ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। সুন্দরবন এলাকায় বাংলাদেশের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করার জন্য তিনি এবার ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত লতিফুর রহমানের নামে প্রবর্তিত ‘লতিফুর রহমান নেচারনোমিকস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ভারতের বালিপাড়া ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার দেয়। প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল খান
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সুন্দরবন এলাকায় বাংলাদেশের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করার জন্য এবার আপনি ‘লতিফুর রহমান নেচারনোমিকস অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন। পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেমন?

মনিরুল খান: আমি এত দিন যে কাজটি করেছি, এই পুরস্কার তার স্বীকৃতি। এটা আমার জন্য ভীষণ অনুপ্রেরণার, যা আমাকে এই কাজে আরও বেশি আগ্রহী, উদ্যমী করে তুলবে। আমাদের দেশে জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ একটি কঠিন কাজ। কারণ, এ দেশে এসব বিষয়ে এখনো বেশি মানুষ সচেতন নন। আমি এ গবেষণা, সংরক্ষণের পাশাপাশি সচেতনতার কাজটিও করে যেতে চাই।

প্রশ্ন :

আপনি দীর্ঘদিন ধরে বন্য প্রাণী ও জলজ প্রতিবেশ নিয়ে কাজ করছেন। এ কাজে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন?

মনিরুল খান: আমার বাবা ব্রিটিশ সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করতেন। মধুপুরগড়ে তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করতেন। তখন ওই বনে বাঘ, ময়ূরসহ অনেক বন্য প্রাণী ছিল। ছোটবেলা থেকে বাবার মুখে আমি বন্য প্রাণীর গল্প শুনতাম।

প্রশ্ন :

আপনি বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানের প্রণেতা। ২০০৬ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং–পদ্ধতির মাধ্যমে শুমারি করে আপনারা প্রায় ২০০টির মতো বাঘের অস্তিত্ব পেয়েছিলেন। তবে সর্বশেষ বন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে। বাঘ কমে যাওয়ার পেছনে কারণ কী বলে মনে করেন?

মনিরুল খান: ২০০৬ সালে গবেষণাটি ছিল আমার ব্যক্তিগত। পরে বন বিভাগ একটি প্রকল্পের অধীনে বড় একটি গবেষণা করেছে। তবে বাঘের সংখ্যার তারতম্য সঠিক। এর কারণ, সুন্দরবনে দস্যুদের হাতে প্রচুর বাঘ শিকার হয়েছে, খাদ্যাভাবে অনেক বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। সেখানে দস্যুদের বড় অংশটি আত্মসমর্পণ করেছে বলে চোরাই শিকার কমেছে।

প্রশ্ন :

সে ক্ষেত্রে বাঘ টিকিয়ে রাখতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন?

মনিরুল খান: দেখুন, বাঘ টিকিয়ে রাখতে বড় কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু মানুষের উৎপাত ও শিকার বন্ধ রাখা এবং তাদের খাদ্য নিশ্চিত করা গেলেই বাঘ টিকে থাকবে।

প্রশ্ন :

অনুকূল পরিবেশ ও খাবারের নিশ্চয়তা পেলে সুন্দরবনে কী পরিমাণ বাঘ থাকতে পারে বলে মনে করেন?

মনিরুল খান: ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবনে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতোধারা, কাদা চর ও ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১ দশমিক ১ শতাংশ, অর্থাৎ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, বাড়ি, বিল। সুন্দরবনের তিনটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেসকো ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। খাবারের নিশ্চয়তা ও চোরা শিকার বন্ধ হলে সুন্দরবনে এখন যে বাঘ রয়েছে, তার দুই গুণ বাঘ নির্বিঘ্নে থাকতে পারে।

প্রশ্ন :

‘মহাবিপন্ন’ বাঘ সংরক্ষণে সরকার যেসব আইন ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলো যথাযথ?

মনিরুল খান: মোটাদাগে যদি বলি, তাহলে সরকার যে বাঘ সংরক্ষণের কৌশলপত্র তৈরি করেছে, সেখানে আমিও যুক্ত আছি। ওই কৌশলপত্রে সংরক্ষণের সব রোডম্যাপ দেওয়া আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, এসব বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পনির্ভর। কিন্তু এটা রাজস্ব খাতের বরাদ্দ দিয়ে সব সময়ই চলমান রাখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব খাতের বরাদ্দ থাকা উচিত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাঘের পাশাপাশি ডলফিনের আবাসস্থল রক্ষায় ইপিএএসআইএই নামে একটি প্রকল্পেও গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন আপনি। এখন প্রায়ই ডলফিনের মৃত্যুর খবর আসছে, এ নিয়ে উদ্বেগও আছে। করণীয় কী?

মনিরুল খান: ওই গবেষণার পর আমরা নতুন তিনটি ডলফিন অভয়াশ্রম করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেগুলো গেজেটভুক্ত হয়েছে। ডলফিন মৃত্যুর প্রধান কারণ, দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো ও মোহনায় ছোট ফাঁসের মিহি সুতার জাল। এসব জালে আটকা পড়ে বেশির ভাগ ডলফিন মারা পড়ে। ডলফিন রক্ষা করতে হলে এসব জালের বিস্তার রোধ করতে হবে।