ছয় শান্তিরক্ষীর পরিবারে আহাজারি

স্বজনেরা এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। প্রধান উপদেষ্টাকে ফোন করে শোক ও সমবেদনা জাতিসংঘ মহাসচিবের।

সুদানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের ড্রোন হামলায় শহীদ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোক। স্বজনদের কেউ এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।

আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেজে শনিবার স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। এ হামলায় দায়িত্বরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন। আহত হন আটজন শান্তিরক্ষী।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গতকাল রোববার দুপুরে তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানায়, হামলায় দায়িত্বরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। তাঁরা হলেন করপোরাল মো. মাসুদ রানা, এএসসি (নাটোর); সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম, বীর (কুড়িগ্রাম); সৈনিক শামীম রেজা, বীর (রাজবাড়ী); সৈনিক শান্ত মণ্ডল, বীর (কুড়িগ্রাম); মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) ও লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)। আর আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, পিএসসি, অর্ডন্যান্স (কুষ্টিয়া); সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, বীর (দিনাজপুর); করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, সিগন্যালস (ঢাকা); ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, ইএমই (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, বীর (কুড়িগ্রাম); সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, ইঞ্জি. (রংপুর); সৈনিক চুমকি আক্তার, অর্ডন্যান্স (মানিকগঞ্জ) ও সৈনিক মো. মানাজির আহসান, বীর (নোয়াখালী)।

আইএসপিআরের পোস্টে বলা হয়, আহত আট শান্তিরক্ষীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এরই মধ্যে তাঁর সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে। তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অপর সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে উল্লেখ করে আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টাকে ফোন জাতিসংঘ মহাসচিবের

বাসস জানায়, ছয় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।

গুতেরেস বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় ভীষণভাবে মর্মাহত।’

এ সময় অধ্যাপক ইউনূসও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি আহত সেনাসদস্যদের দ্রুত উন্নত মানের হাসপাতালে স্থানান্তর ও নিহতদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, আহত শান্তিরক্ষীদের প্রথমে সুদানের একটি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসা সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

এ সময় দুই নেতা বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ মহাসচিবকে আশ্বস্ত করেন যে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জবাবে গুতেরেস বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আস্থা প্রকাশ করেন।

শামীম রেজার শোকাহত বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনেরা। গতকাল রাজবাড়ীতে
প্রথম আলো

‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে’

সৈনিক শামীম রেজার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামে। তাঁর বাবা আলমগীর ফকির। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামীম রেজা ছিলেন সবার বড়। পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন শান্ত স্বভাবের, দায়িত্বশীল একজন তরুণ।

শামীম রেজা ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। চলতি বছরের ৭ নভেম্বর তিনি জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ নিতে সুদানে যান।

গতকাল বিকেলে শামীম রেজার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানজুড়ে স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কান্না দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। ভেতরে শোকাহত মা ও স্ত্রী আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কালুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সেনাবাহিনীর রাজবাড়ী ক্যাম্পের সদস্যরা পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে এসেছেন।

নিহত শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটার দেড় বছর আগে বিয়ে হয়েছে। এখনো তার কোনো সন্তান হয়নি। কত স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে। অন্তত শেষবারের মতো আমার ছেলের লাশটা দেখতে চাই।’

শামীম রেজার মৃত্যুর খবরে এলাকায় নেমেছে শোকের ছায়া। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা নিহত সেনাসদস্যের বাড়িতে গিয়ে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

শোকে স্তব্ধ দুই পরিবার

সৈনিক শান্ত মণ্ডলের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছাট মাধাই গ্রামের মণ্ডলপাড়ায়। তিনি সাবেক সেনাসদস্য নুর ইসলাম মণ্ডল ও সাহেরা বেগমের ছোট ছেলে। তাঁর বড় ভাই সোহাগ মণ্ডল বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত।

অন্যদিকে সৈনিক মো. মমিনুল ইসলামের বাড়ি জেলার উলিপুর উপজেলার উত্তর পান্ডুল গ্রামে। মমিনুল ইসলামের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ের বয়স ৫ বছর।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শান্ত মণ্ডল ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। আর মো. মমিনুল ইসলাম প্রায় ১৮ বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৫ নভেম্বর তাঁরা দুজনই জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সুদানে যান।

গতকাল বিকেলে রাজারহাট উপজেলার ছাট মাধাই গ্রামের মণ্ডলপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পরিবারে শোক চলছে। শান্ত মণ্ডলের স্ত্রী দিলরুবা খন্দকার (বৃষ্টি) পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর খবরে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘শান্ত আমাকে কথা দিয়েছিল দ্রুত ফিরে আসবে। সে কথা ভাঙতে পারে না। আমার শান্তকে এনে দাও।’ বলতে বলতে আবারও মূর্ছা যান তিনি।

উলিপুরে নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়িতেও একই চিত্র। তাঁর মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিয়া বিদেশ যাওনের প্রস্তুতি নিল। অক্টোবর মাসে ছুটিতে আইসা সবার দোয়া নিল। যাওয়ার সময় কইছিল, মা কান্না কোরো না, আমি তাড়াতাড়ি ফিরমু।’ কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ‘সে কারও ক্ষতি করে নাই। তবু কেন আমার ছেলেটারে মারল?’

‘সব স্বপ্ন ভেঙে গেল’

‘আমাদের নতুন সংসার। অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন ভেঙে গেল। এখন স্বামীকেই হারালাম। আমি টাকা চাই না, আপনারা আমার স্বামীকে এনে দেন।’ কথাগুলো বলছিলেন নিহত লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়ার স্ত্রী নূপুর আক্তার (২২)।

সবুজ মিয়ার বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায়। তিনি উপজেলার মহদিপুর ইউনিয়নের ছোট ভগবানপুর গ্রামের প্রয়াত হাবিদুল ইসলামের ছেলে। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে ছোট ভগবানপুর গ্রামে মাতম চলছে।

গতকাল বিকেলে গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ছোট ভগবানপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সবুজ মিয়ার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাঁদের সান্ত্বনা দিতে আশপাশের লোকজন বাড়িতে ভিড় করছেন। সবুজের স্ত্রী নূপুর বারবার লুটিয়ে পড়ছেন।

সবুজের মা ছকিনা বেগম (৬৮) বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলেন, ‘হামার একন্যা ব্যাটা। তাঈ কিসোক বিদেশোত গ্যালো। বিদেশোত না গ্যালে মরলো না হয়। তোমরা হামার ব্যাটাক আনি দেও।’

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই ভাইবোনের মধ্যে সবুজ মিয়া ছোট। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সবুজ। দেড় বছর আগে বিয়ে করেন। গত ৭ নভেম্বর সুদানে যান সবুজ মিয়া।

জাহাঙ্গীরের বাড়িতে মাতম

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামে। বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি। মিশনে যাওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় জাহাঙ্গীরের এমন করুণ মৃত্যু মানতে পারছেন না স্থানীয় মানুষেরা।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ও তিন বছর বয়সের এক সন্তান রয়েছে।

গতকাল জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশীসহ আশপাশের মানুষজন ভিড় করছেন। জাহাঙ্গীরের বাবা হজরত আলী ডুকরে কেঁদে উঠছেন। মা পালিমা বেগমের কান্না থামছে না। তিনি বারবার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তিন বছর বয়সী শিশু ইরফান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল মায়ের দিকে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীর দ্বিতীয়। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। গত ৭ নভেম্বর তিনি শান্তি রক্ষা মিশনে অংশ নিতে সুদানে যান।

স্বামী সবুজ মিয়ার নিহত হওয়ার খবরে গাইবান্ধায় স্ত্রী নূপুরের আহাজারি
প্রথম আলো

সান্ত্বনা পাচ্ছেন না মা

‘এক দিন আগেও বেটার সাথে কথা হইছিল। কেমন আছে জানতে চাইলে বলেছিল, এখন ভালো, খুব একটা ডিউটি করা লাগে না। মা, তোমরা চিন্তা কোরো না, ভালো থেকো।’—কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন করপোরাল (এমটি) মাসুদ রানার (৩৮) মা মর্জিনা বেওয়া।

মাসুদ রানার গ্রামের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার বোয়ালীপাড়া গ্রামে। সন্তান হারানো এই মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছিল না। গতকাল বিকেলে মাসুদ রানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশীসহ আশপাশের অনেক মানুষ ভিড় করেছেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, মাসুদ রানারা তিন ভাই। তিনি ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। গত ৭ নভেম্বর শান্তি মিশনে সুদানে যান।

মা মর্জিনা বেওয়া কেঁদেই চলেছেন। স্ত্রী আসমা উল হুসনা আট বছরের একমাত্র সন্তান মাগফিরাতুল মাওয়াকে বুকে জড়িয়ে নির্বাক বসে আছেন। তিনি বললেন, ‘আমি এখন আমার মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দিব। সে তো সবার কথা ভাবত, এখন ওর মেয়ের জন্য কে ভাববে? এখন আমি কার ফোনের আশায় অপেক্ষা করব!’

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]