কী কারণে দুর্ঘটনা, যা জানা গেল তদন্ত প্রতিবেদনে

ট্রেনটি রাজেন্দ্রপুর স্টেশন পার হয়ে ভাওয়াল রেলস্টেশনে পৌঁছানোর আগেই লাইনচ্যুত হয়।ফাইল ছবি

গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে নাশকতার কারণে। নাশকতার উদ্দেশ্যে এই অংশে রেললাইন কেটে ফেলেছিল দুর্বৃত্তরা। রেললাইন কাটতে ব্যবহার করা হয় অক্সি-অ্যাসিটিলিন ও গ্যাস সিলিন্ডার। তবে কমিটি দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে পারলেও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেনি।

রেললাইন কাটা থাকায় গত ১৩ ডিসেম্বর ভোরে গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশনের কাছে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেলপথে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে এক যাত্রী নিহত হন। আহত হয়েছেন ১২ জন। আর ইঞ্জিন, কোচ ও রেলপথের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় পৌনে ১ কোটি টাকা।

দুর্ঘটনার দিন গত ১৩ ডিসেম্বর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ঢাকা) কার্যালয় থেকে দুর্ঘটনার কারণ এবং দায়দায়িত্ব নির্ধারণে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত শেষে সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদন এখনো তাঁর কাছে আসেনি। এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) মো. শহিদুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। তবে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন ধরেননি মো. শহিদুল ইসলাম।

দুর্ঘটনায় ট্রেনের ইঞ্জিন ও ছয়টি কোচ লাইনচ্যুত হয়েছিল। যাত্রীবাহী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরের দিকে যাচ্ছিল। ট্রেনটির ১৪টি বগিতে ৫৯৪ জন যাত্রী ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ মেরামত করতে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগে।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সাড়ে ১৭ ফুট রেললাইন কেটে ফেলে। গ্যাস দিয়ে এই রেললাইন কাটা হয়। রেললাইন কাটা থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার সময় ট্রেনের গতি ছিল ৪২ কিলোমিটার।

কমিটি রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য, রেলপথ ও এর আশপাশের অবস্থা, সংকেত ও ইঞ্জিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং দুর্ঘটনার ধরন ও নমুনা যাচাই করে এ সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কাটা রেলপথের পাশের ঝোপের মধ্যে একটি গৃহস্থালি রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়। এর একটু দূরে চিলাই ব্রিজের নিচে আরও একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যায়, যা দ্বারা অতি উচ্চমাত্রায় শিখা তৈরি করে দ্রুত ধাতব বস্তু কাটার কাজে ব্যবহার করা যায়। কেটে ফেলা রেললাইনের পাশে একটি কাপড় ও চাদর পাওয়া গেছে। এই কাপড় ও চাদর গ্যাস সিলিন্ডার বহনের কাজে এবং কাটা রেললাইন সরানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।

দুর্ঘটনার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
ফাইল ছবি

দুর্ঘটনার দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি (পুলিশের উপমহাপরিদর্শক) সৈয়দ নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এটি নাশকতার ঘটনা। নাশকতাকারীরা পরিকল্পনা করে রেললাইনকে অক্সি-অ্যাসিটিলিনের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলে।

ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ইঞ্জিন ও কোচগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেললাইন। এগুলো সংস্কার করতে হবে। ইতিমধ্যে রেললাইন সংস্কার করা হয়েছে। কমিটির হিসাবে এই দুর্ঘটনায় ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে রেলপথের ক্ষতি ৯ লাখ টাকা, কোচ, ইঞ্জিন ও সংকেতব্যবস্থা মিলিয়ে ক্ষতি ৮৬ লাখ টাকা।

দুর্ঘটনা রোধে ৫ সুপারিশ
এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এগুলো হচ্ছে ১. রেলওয়ের ওয়েম্যানদের দিয়ে রেলপথ প্যাট্রোলিংয়ের সময় বাড়াতে হবে। লোকবলও বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্যাট্রোলিংয়ের কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২. রেলপথ প্যাট্রোলিংয়ের সময় স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারীদের সঙ্গে ওয়েম্যানরা অবশ্যই কুশল বিনিয়ম করবেন। ৩. রাতের বেলায় চলাচলরত ট্রেনগুলো চলাচলের সময় সতর্কতা অবলম্ব করবে এবং প্রয়োজনে পাইলট ইঞ্জিন পাঠিয়ে ট্র্যাক (রেলপথ) তদারকি করা যেতে পারে। ৪. গুরুত্বপূর্ণ সেতু, কালভার্ট ও সেকশনগুলো বাতি ও সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা যেতে পারে। ৫. নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রোধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

গাজীপুরে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনার পর ঢাকায় দুটি ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মা-শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়। আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই দিন আগে ৫ জানুয়ারি রাত নয়টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে দুই নারী, এক শিশুসহ চারজন মারা যান।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীরা নাশকতার জন্য রেললাইন কেটে দিয়েছে। এ জন্য রেলওয়ের কর্মচারী বা বিভাগকে দায়ী করা যায়নি। এ ঘটনায় ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার) ইমদাদুল হক আহাম্মদ এবং সহকারী ট্রেনচালক মো. সবুজ মিয়া আহত হয়েছেন।