গবেষকের সাক্ষাৎকার

উটপাখি পালন খামারি পর্যায়ে শুরুর জন্য আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন

দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের গবেষণাগারে অর্ধশত ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর চেষ্টা করে সবশেষ গত মঙ্গলবার একটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও গবেষকদের দাবি, ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর ঘটনা এটাই প্রথম। এই গবেষণা ও উটপাখির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদুল ইসলাম

রাশেদুল ইসলাম
প্রশ্ন:

আপনাদের বিভাগে উটপাখি নিয়ে গবেষণার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

রাশেদুল ইসলাম: জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ গাফফার (বর্তমানে নাটোরে অবস্থিত রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির উপাচার্য) ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ২১টি উটপাখির বাচ্চা আনেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় তিনি খামার করে গবেষণা শুরু করেন, আমাদের দেশের আবহাওয়ায় উটপাখির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য। পরবর্তী সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এম এ গাফফারের নেতৃত্বে আমিসহ অধ্যাপক উম্মে সালমা, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, খাদিজা আল ফেরদৌস, হোসনে মোবারক, পিএইচডি গবেষক কামরুজ্জামান, খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম, আহসান হাবিব প্রামাণিক, শিক্ষার্থী মুশফিক রহমান ও খালিদ নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে গবেষণা কার্যক্রম চালান এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। যার ফলে দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হলো কোন প্রক্রিয়ায়?

রাশেদুল ইসলাম: উটপাখি মূলত অতিউষ্ণ আবহাওয়ায় অভ্যস্ত প্রাণী। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর হার অনেক কম। বিরূপ আবহাওয়ায় পুনরুৎপাদন তথা বাচ্চা উৎপাদন ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি মাথায় রেখেই কৃত্রিম উপায়ে তথা ইনকিউবেটরে উটপাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। পরবর্তীকালে অনুকূল পরিবেশ (তাপমাত্রা, আদ্রতা ও অন্যান্য বিষয়) তৈরি করার মাধ্যমে ইনকিউবেটরে সফলভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়েছে।

প্রশ্ন:

দেশে প্রোটিনের চাহিদা পূরণে উটপাখি কতখানি ভূমিকা রাখতে পারবে?

রাশেদুল ইসলাম: উটপাখির লালন-পালন খরচ তুলনামূলকভাবে কম, এমনকি অন্যান্য গবাদিপশুর সঙ্গেও পালন করা যায়। উটপাখি থেকে অনেক মাংস, উন্নতমানের চামড়া, চর্বি, হাড়, পালক পাওয়া যায়। এর মাংস অনেক সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হওয়ায় বিকল্প প্রোটিন হিসেবে সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে উটপাখি নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিস্তর গবেষণা করে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু লাভের আশায় তাড়াহুড়ো না করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা, প্রযুক্তি শুধু উদ্ভাবন করলেই হবে না, প্রযুক্তির ফসল ভোক্তাদের কাছে সহজলভ্য করতে হবে। পাশাপাশি খামারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে হবে। তবেই নতুন এই প্রযুক্তির সফলতা আসবে এবং দেশের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।

প্রশ্ন:

একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে একজন খামারিকে উটপাখিগুলো দেওয়া হয়েছে। কী সমঝোতা হয়েছে?

রাশেদুল ইসলাম: উটপাখির দৈহিক আকার অনেক বড় হওয়ায় চলাফেরার জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন হয়। বাচ্চা উৎপাদনের জন্য দরকার নির্জন ও কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নির্জন পরিবেশ ও পর্যাপ্ত চারণভূমি নিশ্চিত করতেই একজন খামারীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় খামারিকে উটপাখি পালনে কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা খামারে উটপাখি নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করতে পারবেন।

প্রশ্ন:

বিশ্ববিদ্যালয়ে উটপাখিসহ অন্যান্য পশুপাখির ক্ষুদ্র পরিসরে একটি খামার ছিল। সেটির এখন কী অবস্থা?

রাশেদুল ইসলাম: বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সমন্বয়ে খামারটি এখনো চলমান। প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী ও পাখিপ্রেমীরাও আসেন এখানে। বর্তমানে খামারটিতে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস-মুরগিসহ বিলুপ্তপ্রায় ২০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তবে এসব প্রাণী লালন-পালন করা অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এম কামরুজ্জামান সার্বিক সহায়তা প্রদান করছেন। ফলে আরও নতুন নতুন প্রাণী সংযুক্ত করা এবং বিভিন্ন প্রায়োগিক গবেষণার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন:

উটপাখি নিয়ে আপনাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

রাশেদুল ইসলাম: বর্তমানে যে গবেষণা চলছে তা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর সফলতা যা এসেছে তার জন্য গবেষক দল অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে এই গবেষণার ফসল মাঠপর্যায়ে, তথা খামারিদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আরও উচ্চতর গবেষণা করা প্রয়োজন। যার জন্য প্রয়োজন হবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (একই ধারার গবেষণায় যুক্ত) সঙ্গে আন্তসম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যমে উদ্যমী গবেষক দল তৈরি করা ও পর্যাপ্ত গবেষণা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা। আমরা উচ্চতর গবেষণার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা প্রকল্প উপস্থাপনের মাধ্যমে অর্থের সংস্থানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।

প্রশ্ন:

উটপাখি ছাড়াও জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগে আর কোন কোন প্রাণী নিয়ে গবেষণা চলছে?

রাশেদুল ইসলাম: এই বিভাগ সব সময়ই দেশি জাতের প্রাণীর জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিকল্প প্রোটিনের উৎস হিসেবে বিভিন্ন প্রাণীর সম্ভাব্যতা যাচাই ও উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জাতের মুরগি, কবুতর, টার্কি, ময়ূর, খরগোসসহ অন্যান্য প্রাণী নিয়ে গবেষণা চলমান। আমাদের পরিবেশে পাওয়া বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান যেমন আর্সেনিক, প্লাস্টিকের কারণে মানবশরীর ও প্রাণীতে সৃষ্ট বিষাক্ততা নির্ণয় এবং এই বিষাক্ততা দূরীকরণে ইঁদুরের ওপর উচ্চতর গবেষণায় উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে। অধিকতর গবেষণা কার্যক্রম চলমান।