সাফ জয়ে নেতৃত্ব দেওয়া রজনীকান্ত বর্মনের দুঃসময়ে পাশে নেই কেউ

বাড়ির উঠানে রজনীকান্ত বর্মন। সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের পিঙ্গাবহ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রজনীকান্ত বর্মন। স্কুলের দল থেকে ক্লাব, ক্লাব থেকে জাতীয় ফুটবল দল; দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সর্বত্র। অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলকে, এনে দিয়েছেন শিরোপা। ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে মিটিয়েছেন দর্শকের চাওয়া। সেই রজনীর ঘরে এখন শুধুই অন্ধকার।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের পিঙ্গাবহ গ্রামে নিভৃত গ্রামে দিন-রাত কাটছে রজনীর। তিনি এই গ্রামের রাধা কান্ত বর্মনের সন্তান। বছরখানেক আগে এক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পাওয়ার পর কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না তিনি। সেই পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় নিঃস্ব হতে বসেছেন। এমন দুঃসময়ে কাউকে পাশে না পাওয়ার আক্ষেপে পুড়ছেন তিনি।

২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। দেশের ফুটবল ইতিহাসে যা সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে দেখা হয়। সেই টুর্নামেন্টে দলকে নেতৃত্ব দেন রজনীকান্ত বর্মন। গোটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের রক্ষণ বুক পেতে সামলেছিলেন। ওই সময় দক্ষিণ এশিয়ার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে সাফ গেমস চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ, ওই দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে দাপটের সঙ্গে ৫৩টি ম্যাচ খেলেছেন রজনী।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের হুগলি জেলায় শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন রজনীকান্ত। মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি তাঁর পায়ের ওপর উঠিয়ে দেয়। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে যান তিনি। চিকিৎসকেরা প্রথমে পা কেটে ফেলার কথা বললেও পরে বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করে পা কাটা থেকে রক্ষা পান। যদিও এখন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক এই খেলোয়াড়। কবে ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে এরও নিশ্চয়তা নেই। এমন দুর্দিনে ফুটবল অঙ্গনের কেউ নেই তাঁর পাশে। চিকিৎসা ব্যয় চালাতে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। বিক্রি করে শেষ করেছেন ফুটবল খেলে গড়া সম্পদ।

ভারতে চিকিৎসা করতে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে রজনীকান্তের। এখনো ডান পা সম্পূর্ণ অচল
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি এক দুপুরে পিঙ্গাবহ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে একাকী বসে আছেন রজনীকান্ত বর্মন। অথচ যখন খেলার মাঠ দাঁপিয়ে বেড়াতেন, তখন বাড়িতে শত শত মানুষ তাঁকে একনজর দেখতে ভিড় করতেন।

রজনীকান্ত বর্মন বলেন, ‘প্রায় এক যুগ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি, দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি। দেশের হয়ে গৌরব বয়ে এনেছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছি। আজ পাশে কেউ নেই। ভবিষ্যতে নিয়তি কোন পথে নিয়ে যায়, সে নিয়েই ভাবনা।’

আরও পড়ুন

ভারতে চিকিৎসা করতে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে রজনীকান্তের। এখনো ডান পা সম্পূর্ণ অচল। কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না তিনি। অর্থের অভাবে আগামীর চিকিৎসাও এখন অনিশ্চিত।

রজনীকান্ত জানালেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা শেষে ভারত থেকে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। আড়াই মাস আগে তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে ভারতে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের অসুস্থতার জন্য স্ত্রীকে বিদায় জানাতে ভারতে যেতে পারেননি। সংসারে অভাবের কারণে দুই মেয়ে এখন ভারতে নানাবাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছেন। সংসারের বড় ছেলে হিসেবে তাঁর কাঁধে মা, ভাই ও বোনদের দেখভালের দায়িত্ব।

সংসারের ব্যয় আর চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে। অথচ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বা সরকার তাঁর কোনো খোঁজ নেয়নি। রজনীকান্ত বলেন, ‘জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হয়েও অসুস্থ হয়ে এক বছর ধরে বিছানায় পড়ে রয়েছি। কেউ খোঁজ নেয়নি, এক দিনের জন্যও ফুটবল ফেডারেশন থেকে ফোন করে একটু সান্ত্বনা মেলেনি। এটাতেই এখন পীড়া দেয় নিজের মনে। দেশের গৌরবের জন্য খেলার মাঠ দাঁপিয়ে বেড়ালেও আজ তো পাশে কেউ নেই।’

২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ফুটবলকে বিদায় জানানোর দিনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রজনীকান্ত বর্মন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নিজের দুঃসময়ে সরকার বা ফুটবল ফেডারেশনকে পাশে চান একসময়ের এই মেধাবী খেলোয়াড়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ফুটবলার না হয়ে বরং চাকরীজিবী হলেও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি শেষ বয়সে কিছুটা হলে ভালো থাকা যেত।

ফুলবাড়িয়া আক্কেল আলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, রজনী চিকিৎসা করাতে গিয়ে একেবারে নিঃস্ব। তাঁর দিন খুবই কষ্টে কাটছে। তাঁর মতো একজন বড় খোলোয়াড়ের পাশে ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের এগিয়ে আসা উচিত।

সাফজয়ী ওই অধিনায়কের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ‘রজনীকান্তকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। তাঁর জন্য কিছু করা প্রয়োজন। তিনি যদি লিখিতভাবে আবেদন করেন, তাহলে সরকারিভাবে তাঁকে সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে।’

আরও পড়ুন