কোটি টাকার গাছ লুট 

গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে গাছগুলো কাটেন ইউপি সদস্য হাবুল ব্যাপারী।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবুল বেপারির নেতৃত্বে সড়কের পাশ থেকে গাছ কেটে নেওয়া হয়প্রথম আলো

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নিলাম দরপত্রের ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সদস্য শতাধিক গাছ কেটে নিয়েছেন। গত সপ্তাহে এক আওয়ামী লীগ নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ওই কার্যাদেশ দেখিয়ে কোটি টাকার গাছগুলো কেটে নেওয়া হয়। এই ঘটনা ঘটেছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে সওজের উপবিভাগীয় বৃক্ষপালনবিদ (অ.দা.) ঢাকার পাইকপাড়া  কার্যালয় থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জয়শ্রী-বাটাজোর ভায়া সানুহার পর্যন্ত গাছ অপসারণের জন্য গৌরনদী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামার ওরফে ফরহাদ হোসেন মুন্সীর এলাহী অ্যাগ্রো লিমিটেডের নামে ভুয়া কার্যাদেশ বের করা হয়। ওই ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে গাছগুলো কেটে নেন গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাবুল ব্যাপারী (৪৮)। 

গাছ অপসারণের টেন্ডারের দায়িত্ব আমাদের নয়। এ দায়িত্ব বৃক্ষপালনবিদ বিভাগের। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি, গাছ অপসারণের কার্যাদেশ ভুয়া।
মো. মাসুদ মাহমুদ, নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ, বরিশাল

ইউপি সদস্য হাবুল ব্যাপারী গৌরনদী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুজ্জামানের নির্দেশে গাছ কাটার কথা জানালেও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সওজের গাছ অপসারণের কোনো দরপত্রে অংশ নিইনি এবং আমার নির্দেশে কোনো গাছ কাটার কথা সত্য নয়।’ 

স্থানীয় লোকজন, গাছ ব্যবসায়ী, সুবিধাভোগী, কার্যাদেশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-বরিশাল-মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য মহাসড়কের গাছ অপসারণ করতে ২০২৩ সালের জুন মাসে গাছে নম্বর ফেলা হয়। প্রথম ধাপে বরিশাল থেকে ভূরঘাটা পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশের রেইনট্রি ও চাম্বলগাছ নিলাম দরপত্র আহ্বান করে অপসারণ করে সওজ কর্তৃপক্ষ। পরে ১৫ জানুয়ারি থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জয়শ্রী থেকে বাটাজোর ভায়া সানুহার পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে ২৫-৩০ জন শ্রমিক দিয়ে মেহগনি ও শিশুগাছ কাটা শুরু করেন ইউপি সদস্য হাবুল ব্যাপারী। তিনি ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫০টি গাছ কেটেছেন। এর মধ্যে ১০০টি গাছ তিনি সরিয়ে ফেলতে পেরেছেন। বাকি গাছগুলো সওজের কর্মকর্তারা ২৩ জানুয়ারি জব্দ করেছেন। ওই অভিযানের পর থেকে হাবুল ব্যাপারী ও তাঁর শ্রমিকেরা উধাও হয়ে গেছেন। এখন গাছ কাটা বন্ধ রয়েছে।

স্থানীয় মানুষেরা জানান, ইউপি সদস্য হাবুল শ্রমিক নিয়ে ১৫ জানুয়ারি থেকে দিনরাত তড়িঘড়ি করে গাছ কেটে পাঁচ-সাতটি ট্রাকে করে সেগুলো নিয়ে যান। সন্দেহ হলে একপর্যায়ে গাছ কাটার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে তাঁরা গাছ কাটার কার্যাদেশ দেখতে চান। তখন হাবুল কার্যাদেশ না দেখিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। একপর্যায়ে ২২ জানুয়ারি একটি কার্যাদেশ দেখান। কিন্তু ওই কার্যাদেশ ভুয়া ছিল। 

ওই কার্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, সওজ উপবিভাগীয় বৃক্ষপালনবিদ (অ.দা.) পাইকপাড়া ঢাকার কার্যালয় থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জয়শ্রী থেকে বাটাজোর ভায়া সানুহার পর্যন্ত গাছ অপসারণের জন্য ৩১ ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজের নাম বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন ভূরঘাটা-বরিশাল মহাসড়কের গাছ অপসারণ। ৩০ দিনের মধ্যে গাছ কাটার কাজ শেষ করতে হবে। দরদাতার নাম এলাহী অ্যাগ্রো লিমিটেড। ওই কার্যাদেশে পাইকপাড়া ঢাকা সওজ বিভাগের উপবিভাগীয় বৃক্ষপালনবিদ (অ.দা.) মো. আমানাত আলীর সই রয়েছে। 

স্থানীয় মাহফুজুর রহমান ও জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গাছ অপসারণের কার্যাদেশ পাওয়ার পর তাঁরা ঢাকা ও বরিশালের সওজের কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে তাঁদের জানানো হয়, এ ধরনের কোনো কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। 

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জয়শ্রী থেকে বাটাজোর ভায়া সানুহার প্রায় চার কিলোমিটার পর্যন্ত মহাসড়কের পাঁচটি স্থান থেকে ইউপি সদস্য হাবুল ব্যাপারীর নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন শ্রমিক বিশাল বিশাল মেহগনি ও শিশুগাছ কাটছেন।

 এ বিষয়ে সওজের বরিশাল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদ মাহমুদ বলেন, ‘গাছ অপসারণের টেন্ডারের দায়িত্ব আমাদের নয়। এ দায়িত্ব বৃক্ষপালনবিদ বিভাগের। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, গাছ অপসারণের কার্যাদেশ ভুয়া। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপসহকারী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দিয়েছি।’

সওজের উপসহকারী প্রকৌশলী অরুণ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘কতিপয় অসাধু ব্যক্তি জাল-জালিয়াতির আদেশ বের করে মহাসড়কের গাছ কেটে নিচ্ছিলেন। আমি খবর পেয়ে মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে ৫০টির বেশি কাটা গাছ জব্দ করেছি। এই ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।