সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

অসুস্থ মা শয্যাশায়ী। তাই ইভার স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে গরিব–অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু অভাবের সংসারে তার উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়া নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কোথায় পড়বে, কীভাবে পড়বে—নানা শঙ্কা আর সিদ্ধান্তহীনতায় প্রথম ধাপে পছন্দের কলেজে আবেদন করা হয়নি তার। একই রকম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে পটুয়াখালী সদরের রুপক কুমার, সেলিনা আক্তার ও খাদিজা আক্তারের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের পরিবারে।

পড়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় ইভা

ইভা আক্তার এবার পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঝাটিবুনিয়া মোজাফ্ফর ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের বাড়ি উপজেলার উত্তর ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। তার বাবা মহিষকাটা বাজারে ছোট্ট একটি দোকানে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন। এ অবস্থায় ইভা এবং তার কলেজপড়ুয়া বড় ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ জোগানো তাঁর জন্য কষ্টকর।

ইভা বলে, তার মা শয্যাশায়ী। টাকার অভাবে ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে না। নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হয়। মা অসুস্থ থাকায় সংসারের যাবতীয় কাজও সামলাতে হয় তাকে। তবু ইচ্ছাশক্তির জোরে সে এসএসসিতে ভালো ফলাফল করেছে।

ইভা আরও বলে, ‘ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু চিকিৎসক হওয়া তো দূরের কথা, উচ্চমাধ্যমিকে পড়া হবে কি না, বুঝতে পারছি না। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় পড়াশোনা করেছি। কিন্তু এবার কলেজে ভর্তি, বই-খাতা কেনা, প্রাইভেট, কোচিং করার সামর্থ্য আমার বাবার নেই।’

ঝাটিবুনিয়া মোজাফ্ফর ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস ছাত্তার বলেন, ইভা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত অংশগ্রহণ করত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। একটু সহযোগিতা পেলে হয়তো মেয়েটি জীবনে অনেক উন্নতি করবে।

দুশ্চিন্তায় রুপকের মা–বাবা

পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে রুপক কুমার। ছেলের ভালো ফলাফল মা-বাবার দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। রুপকের বাবা জগদীশ চন্দ্র শীল শহরের একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে রুপক ছোট। রুপকের মা রীনা রানী সেলাইয়ের কাজ করেন। শহরের চরপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় তাঁদের সংসার।

পাড়া-প্রতিবেশী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় রুপক এত দিন লেখাপড়া চালিয়ে আসছিল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন জানান, রুপক মেধাবী ছেলে। এত দিন তাঁরা লেখাপড়ায় সহায়তা করেছেন।

রুপকের বাবা জগদীশ চন্দ্র বলেন, ‘আমি আর পারছি না ছেলেরে লেহাপড়া করাইতে। অনেক দেনা রয়েছে। রুপকের লেহাপড়ার ভার দেশের দশজনের ওপর ছেড়ে দিলাম।’

চিকিৎসক হতে চায় সেলিনা

ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের হাট গোবিন্দপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সেলিনা আক্তার। তার বাবা সেলিম শেখ স্থানীয় হাট গোবিন্দপুর বাজারের একটি দরজির দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। মা ফরিদা পারভীন গৃহবধূ। এইচএসসি পড়ার জন্য সে ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে সুযোগ পেয়েছে। তার ইচ্ছা চিকিৎসক হওয়া। কিন্তু খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে পরিবারের লোকজন।

ফরিদা বেগম বলেন, যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে সংসারে মেয়েকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কল্পনাও করা যায় না। মেয়ের ইচ্ছা কীভাবে পূরণ করবেন! দুমুঠো ভাত জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়ে।

সেলিনাদের বাড়ি হাটগোবিন্দপুর গ্রামে। সাকল্যে ৪ শতাংশ জমি আছে। সেখানে একটি দোচালা টিনের ঘরে বসবাস করছেন তাঁরা।

হাট গোবিন্দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিত্ত রঞ্জন দাস বলেন, সেলিনা মেধাবী শিক্ষার্থী। সে ডাক্তার হতে চায়। তার পক্ষে এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই দরিদ্র পরিবারের এ ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা নেই।

মায়ের সমর্থনে এগিয়েছে খাদিজা

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের অন্তাহার গ্রামের বাসিন্দা খাদিজা আক্তার। বাবা খায়রুল ইসলাম পেশায় একজন জেলে আর মা রোমানা খাতুন গৃহিণী। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় ছাতিয়ানগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

খাদিজা বলে, বাবার সামান্য আয়ে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। পড়াশোনার প্রেরণা ছিল মা। মা তাকে সাহস জুগিয়েছেন, দিয়েছেন প্রেরণা। নিয়মিত প্রাইভেট বা কোচিং করার মতো সামর্থ্য না থাকায় খাদিজা বাড়িতেই মন দিয়ে লেখাপড়া করত। স্কুলে শিক্ষকেরা তাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। আরও পড়াশোনা করে সে প্রকৌশলী হতে চায়।

ছাতিয়ানগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইছাহাক আলী বলেন, আর্থিক সহযোগিতা পেলে খাদিজা অনেক দূর যেতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর; শংকর দাস, পটুয়াখালী; খায়রুল ইসলাম, আদমদীঘি, বগুড়া ও মো. জাকির হোসেন, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী]