শেষ কথায় স্ত্রী-সন্তানকে দেখে রাখতে বলেছিলেন জসিম

জসিম উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দিয়ে সূদুর মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে গেলেও জসিম উদ্দিনের মনটা পড়ে থাকত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার কাটিঙ্গা গ্রামে। সব সময় চিন্তা করতেন স্ত্রী ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবশেষ গত সোমবার রাতেও ভাবি জাহানারা বেগমের সঙ্গে মুঠোফোনে সেই কথাই বলেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন পড়াশোনা করিয়ে দুই ছেলেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু সেই কথাই যে শেষ কথা হবে, তা মানতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।

স্থানীয় সময় সোমবার রাত সাড়ে আটটায় (বাংলাদেশ সময় সোমবার দিবাগত রাত দেড়টা) মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সময় ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণে জসিম উদ্দিনসহ (৩২) তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন। বর্তমানে জসিমের বাড়ি বিজয়নগরের কাটিঙ্গা গ্রামে চলছে শোকের মাতম।

জসিম কাটিঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরু মিয়ার ছেলে। তাঁর স্ত্রী (শারমিন বেগম) ও দুই ছেলেসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে মোহাম্মদ একরাম হোসেনের বয়স ছয় বছর। ছোট ছেলে মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের বয়স চার বছর।

জসিমের বয়স যখন আড়াই বছর তখন তাঁদের বাড়িতে বউ হয়ে আসেন জাহানারা বেগম। ছোট থেকে মায়ের মতো আদর করে জসিমকে বড় করেছেন ভাবি জাহানারা। জসিমও তাঁকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। জাহানারা বেগম বলছিলেন, ‘যেখানেই যেত আমাকে নিয়ে যেত এবং মা বলে পরিচয় করিয়ে দিত। জসিম খুব ভালা ও শান্ত স্বভাবের ছিল।’

সোমবার রাতে জসিমের সঙ্গে জাহানারার শেষ কথা হয়েছিল। জাহানারা বলেন, ‘জসিম তখন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে দেখে রাখার কথা বলে। সে বলেছিল, ‘‘তোমরা ছাড়া তাদের কেউ নেই। দুই সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করো।’’’

আরও পড়ুন

জসিম ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট ৬১ ই বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় জসিমের স্ত্রী শারমিনের কাছে ফোন আসে। সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দফায় দফায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বারবার জসিমের কথা জিজ্ঞাসা করলে ওপাশ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বারবার একটি কথা বলছিল, ‘জসিমের জন্য দোয়া করেন’। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আফ্রিকা থেকে ফোন আসে। এ সময় জসিম মারা গেছেন বলে জানানো হয়।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সময় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের একটি বহর টহল থেকে ফেরার সময় পথে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বহরের প্রথম গাড়িটি আক্রান্ত হয়। সেটি ছিটকে ১৫ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। এতে তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত ও একজন আহত হন।

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের পশ্চিম সেক্টরের বোয়ার এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন (ব্যানব্যাট-৮) ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর থেকে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত আছে। দুর্গম এলাকার অস্থায়ী ক্যাম্প কুই থেকে পরিচালিত যান্ত্রিক টহলের একটি দল মেজর আশরাফের নেতৃত্বে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কাইতা এলাকায় টহলে যায়। বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টার দিকে ফেরার পথে টহল কমান্ডার মেজর আশরাফকে বহনকারী প্রথম গাড়িটি মাটিতে পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণের কবলে পড়ে। সৈনিক শরিফ, জাহাঙ্গীর ও জসিম গুরুতর আহত হন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুততার সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের ১৪৪ কিলোমিটার দূরে বোয়ারে অবস্থিত মিনুসকা হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে সৈনিক জসিম উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম ও শরিফ হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

জসিমের লাশ দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে তাঁর পরিবার। পাশাপাশি জসিমের স্ত্রী ও দুই সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়ার দাবিও তাঁদের।

বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ ইরফান উদ্দিন আহম্মেদ জানান, জসিমের লাশ দ্রুত দেশে আনার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তাঁর পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।