বাদী নাম দেননি, তবু হত্যা মামলায় আসামি দুই ইউপি চেয়ারম্যান
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চান্দনী এলাকায় গত শুক্রবার সকালে আবু সিদ্দীক ঢালী নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এলাকাটি ভোজেশ্বর ইউনিয়নে পড়েছে। ওই ঘটনায় গতকাল রোববার রাতে নিহত আবু সিদ্দীকের বড় ভাই আবু আলেম বাদী হয়ে নড়িয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। এতে ৪৩ জনের নাম উল্লেখ এবং ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
বাদী অভিযোগ করেছেন, তিনি মামলায় ২৫-৩০ জনের নাম দিয়েছেন। এজাহারে উল্লেখ করা বাকি আসামিদের নাম তিনি দেননি। এমনকি তাঁদের চেনেন না। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের চাপে পুলিশ তাঁদের নাম দিয়েছে, দাবি মামলার বাদীর। তবে পুলিশ বলছে, কাকে আসামি করা হবে, তার এখতিয়ার বাদীর। এ বিষয়ে পুলিশ কোনো ভূমিকা রাখে না।
মামলার এজাহারে নাম রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দুজন চেয়ারম্যানের। তাঁরা হলেন ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান ও সখীপুর থানা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ইউনুছ মোল্যা এবং একই উপজেলার দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান ও সখীপুর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল মাল। এ দুজনের নাম বাদী দেননি বলে দাবি করেছেন।
তবে পুলিশ বলছে, এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তর তারাবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান ইউনুছ মোল্যা হজ পালনের জন্য বর্তমানে সৌদি আরবে রয়েছেন। হত্যার ঘটনাটি তাঁর সৌদি আরবে থাকাকালেই ঘটেছে। দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউপির চেয়ারম্যান শাহজালাল গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।
নড়িয়া থানার পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের নড়িয়ার চান্দনী গ্রামের আবু সিদ্দীক ঢালীকে গত বৃহস্পতিবার রাতে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন শুক্রবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মার যান তিনি।
আমি তাঁদের (দুই ইউপি চেয়ারম্যান) চিনি না। তাঁরা আমাদের এখানে কেন আসবেন? কীভাবে তাঁরা আসামি হয়েছেন, তা–ও আমি জানি না। অচেনা মানুষদের নাম বিএনপি নেতারা দিয়েছেন। ওই নাম বাদ দিতে বললে তাঁরা আমাকে বিএনপির এক বড় নেতার নাম নিয়ে হুমকি দিয়েছেন। তাঁরা মামলাই করতে দেবেন না, এমন বলেছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, চান্দনী গ্রামের যুবলীগ নেতা ইয়াকুব ছৈয়ালের পরিবারের সঙ্গে আবু সিদ্দীকের পরিবারের ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ওই বিরোধে ২০১৮ সালে খুন হন ইয়াকুব। ওই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন আবু সিদ্দীক ও তাঁর দুই ভাই। অভিযোগ উঠেছে, ওই বিরোধের কারণেই তাঁর সমর্থকদের হাতে খুন হন আবু সিদ্দীক।
জানতে চাইলে মামলার বাদী আবু আলেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার সব আসামির নাম আমার দেওয়া না। কিছু আসামি স্থানীয় বিএনপির নেতারা দিছেন। ওসি স্যার আমাকে মামলা পড়ে শুনাইছেন, তখন আমি তাঁকে বলেছি, ওই সকল আসামি আমার না। আমি তাদের চিনি না। তখন তিনি আমাকে বলেছেন, “আপনার দেওয়া আসামিদেরই ধরা (গ্রেপ্তার করা) হবে।” আমার দেওয়া আসামিদের নাম লাল কালির চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন।’
দুই ইউপি চেয়ারম্যানকে আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু আলেম বলেন, ‘আমি তাঁদের চিনি না। তাঁরা আমাদের এখানে কেন আসবেন? কীভাবে তাঁরা আসামি হয়েছেন, তা–ও আমি জানি না। অচেনা মানুষদের নাম বিএনপি নেতারা দিয়েছেন। ওই নাম বাদ দিতে বললে তাঁরা আমাকে বিএনপির এক বড় নেতার নাম নিয়ে হুমকি দিয়েছেন। তাঁরা মামলাই করতে দেবেন না, এমন বলেছেন।’ তবে তিনি স্থানীয় ওই বিএনপির নেতাদের নাম বলতে রাজি হননি।
ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুছ মোল্যা সৌদি আরব থেকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি পবিত্র হজব্রত পালন করার জন্য সৌদি আরবে রয়েছি। গত ১৪ মে ঢাকা থেকে সৌদি আরবে আসি। হত্যা মামলার এজাহারে আমার নাম দেখে অবাক হয়েছি। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এক বিএনপি নেতার পরামর্শে মামলার বাদী এমন করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
দক্ষিণ তারাবুনিয়ার ইউপির চেয়ারম্যান শাহজালাল মাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। নানা কারণে এলাকায় থাকতে পারি না। তারপরও ফাঁসানোর জন্য ও হয়রানি করতে বিএনপি নেতারা নড়িয়ার একটি হত্যা মামলায় আমাকে আসামি করেছেন।’
এ ছাড়া আসামির তালিকায় রাজীব হাওলাদার ওরফে সিরাজ নামের একজনের নাম রয়েছে, যিনি ১০ জুন থেকে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ১০ জুন নড়িয়ার ভোজেশ্বর এলাকার একটি মারামারির ঘটনায় আহত হন রাজীব। ওই মারামারিতে তাঁর বাবা এমদাদ হোসেন নিহত হন। রাজীব ১৭ জনকে আসামি করে নড়িয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এখন আবু সিদ্দীক হত্যা মামলায় তাঁকে ও তাঁর ভাই বাদশা হাওলাদারকে আসামি করা হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রতিপক্ষের হামলায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আমাকে বাঁচাতে এসে আমার বাবা খুন হয়েছেন। আমার বাবার হত্যাকারীরা ষড়যন্ত্র করে আবু সিদ্দীক হত্যা মামলায় আমার ও আমার ভাইয়ের নামে জুড়ে দিয়েছেন, যাতে আমার বাবার হত্যা মামলাটি আমরা না চালাতে পারি।’
এ নিয়ে জানতে চাইলে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম উদ্দিন মোল্যা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার এজাহারে স্বাক্ষর করেছেন বাদী। কাকে আসামি করা হবে, তার এখতিয়ার বাদীর। এ বিষয়ে পুলিশ কোনো ভূমিকা রাখে না। তবে মামলা রেকর্ড হওয়ার পর বাদী কয়েকজনের নাম বাদ দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, তদন্ত করে বাদ দিতে হবে। আর মামলায় যদি কোনো নিরীহ ব্যক্তি আসামি হয়ে থাকেন, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’