মাসুম শেখ এখন দিনমজুর। আগে জাহাজ থেকে কয়লাবোঝাই ঝুড়ি মাথায় করে তীরে নামাতেন। কয়লার গন্ধ ও ধুলোয় তাঁর শ্বাসকষ্ট হয়। তিনি কয়লা বহনের কাজ ছেড়ে দিয়ে মজুরের কাজ শুরু করেন। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায় মাসুমের নাম ছিল।
আজ সোমবার সকালে চাল কিনতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তালিকায় তাঁর নাম নেই। চাকরিজীবী দেখিয়ে তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে মাসুম সোজা চলে আসেন উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে। তালিকায় নাম পুনর্বহালের দাবিতে সেখানে তিনি বিকেল পর্যন্ত অবস্থান করেন।
মাসুম শেখের মতো তালিকায় নাম পুনর্বহালের দাবিতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ১৮ জন উপকারভোগী আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে ধরনা দিয়েছেন। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এ সময় দাপ্তরিক কাজে কার্যালয়ের বাইরে ছিলেন। এরপর বিকেল চারটার দিকে তাঁরা উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি অন্য একজন ইউপি সদস্যপ্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছিলাম। তিনি জিততে পারেননি। এ জন্য বর্তমান মেম্বার আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি আমার নাম কেটে দিয়েছেন। খুব কষ্টে আছি।
লিখিত অভিযোগে বাদ পড়া উপকারভোগীরা উল্লেখ করেন, তাঁরা কয়েক বছর ধরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পেয়ে আসছেন। দুই মাস আগে বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্য অনলাইনে নিবন্ধনের জন্য তাঁদের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড জমা দিতে বলেন। সে অনুযায়ী তাঁরা জমা দেন। পরে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের নাম অনলাইনে নিবন্ধন হচ্ছে না। কার্ডও ফেরত দেওয়া হয়নি। আজ চাল দেওয়া শুরু হলে সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের ৪৩ জনের নাম তালিকা থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে।
মাসুম শেখের বাড়ি বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বগুড়াতলা গ্রামে। মাসুম শেখ বলেন, ‘গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি অন্য একজন ইউপি সদস্যপ্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছিলাম। তিনি জিততে পারেননি। এ জন্য বর্তমান মেম্বার আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি আমার নাম কেটে দিয়েছেন। খুব কষ্টে আছি।’
একই গ্রামের গৃহবধূ সালমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। খুব কষ্টে আমাদের দিন চলে। পাকা বাড়ির মালিক দেখিয়ে তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচনে অন্য একজন মেম্বার প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলাম। এই কারণে রাজু মেম্বার আমার নাম কেটে দিয়েছেন। এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
অভয়নগর গ্রামের দিনমজুর অজিয়ার রহমানের নিজের কোনো জমি নেই। বাবার জমিতে ছোট একটি কাঠের ঘর করে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সেখানে তিনি থাকেন। ওপরে টিনের ছাউনি। অজিয়ার রহমানকে পাকা বাড়ির মালিক ও বিত্তবান দেখিয়ে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে অন্য একজন মেম্বার প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলাম। এই কারণে রাজু মেম্বার আমার নাম কেটে দিয়েছেন। এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রাজু সরদার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আমি সরেজমিনে যাচাই–বাছাই করে তালিকা সংশোধন করেছি।’ ইউপি চেয়ারম্যান মো. তৈয়েবুর রহমান বলেন, এ রকম হয়ে থাকলে সেটা ঠিক হয়নি। উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্তের আশ্বাস
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পল্লি অঞ্চলের দরিদ্র জনসাধারণকে স্বল্প মূল্যে খাদ্যসহায়তা দিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণ (বিক্রি) কর্মসূচি শুরু হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত বিধবা, বয়স্ক, পরিবারপ্রধান নারী, নিম্ন আয়ের দুস্থ পরিবারপ্রধানদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাল দেওয়ার জন্য একটি তালিকা রয়েছে। প্রতিবছরের মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলে। আগে ১০ টাকা দরে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রি করা হতো। গত বাজেটে এর দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজি করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ১৫ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে।
অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে। তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণিত হলে তাঁদের তালিকায় বহাল করা হবে।
অভয়নগর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তালিকাভুক্ত উপকারভোগী রয়েছেন ২১৩ জন। আজ ওই ওয়ার্ডে ভোক্তার কাছে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে।
সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির অনিয়ম দূরীকরণ, তালিকা সঠিকভাবে তৈরি ও একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নাম থাকা রোধ করতে ডিজিটাল ডেটাবেজের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ৩১ আগস্টের মধ্যে উপকারভোগীর তথ্য ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরির জন্য যাচাই শেষ করার কথা। পরে সময় বাড়িয়ে তা ৩০ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ উপকারভোগী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা কমিটিতে পাঠায় এবং উপজেলা কমিটি তা অনুমোদন করে। উপজেলা কমিটি অন্য খাদ্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত নন, এমন হতদরিদ্র প্রতি পরিবারের একজনের নামে ছবিসহ কার্ড ইস্যু করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সদস্যসচিব।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মীনা খানমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি ইউএনও মেজবাহ উদ্দীন বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে। তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণিত হলে তাঁদের তালিকায় বহাল করা হবে।’